‘বুঙার’ আশীর্বাদে শতকোটি টাকার মালিক সিলেটের আবুল

নিজস্ব প্রতিবেদকঃঃ

আবুল হোসেন কিভাবে এত অল্প সময়ে কয়েক শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেলেন? এই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জৈন্তাপুর ও হরিপুরের স্থানীয় বাসিন্দাদের মাথায়।

আওয়ামী লীগের শাসনামলের শেষ দু’বছরে চিনি ‘বুঙার’ লাইনের মালিক হয়ে দু’হাতে টাকা কামিয়েছেন আবুল হোসেন। আর এই টাকা দিয়ে নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেছেন।

কতো টাকার মালিক বুঙারী আবুল- এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই অনুমান করতে পারছেন না।

দুই বছরে প্রতিদিন ৫০-৬০ লাখ টাকা কামিয়েছে বলে জানিয়েছেন এলাকার মানুষ।

এ কারণে কেউ বলছেন, শতকোটি টাকার মালিক। তবে অঢেল সম্পদের মালিক যে হয়েছে, তার প্রমাণ মিলে সিলেটের চিনি চোরাকারবারের নিরাপদ জোন হরিপুরের উতলার পাড়ে গড়ে তোলা অট্টালিকা দেখে।

৩-৪ কোটি টাকা খরচ করে ওই অট্টালিকা নির্মাণ করা হচ্ছে।

এলাকাবাসীর সূত্রে জানা যায়, আবুল হোসেনে চোরাচালান জগতে প্রবেশ করেন ভারত থেকে অবৈধভাবে চা পাতায় এনে তা তিনি সিলেট শহরে বিক্রি করতেন। এভাবেই প্রথমে চোরাচালান জগতে পা রাখেন আবুল হোসেন।

 

পরবর্তীতে তিনি নিজেই গড়ে তুলেন চোরাচালান ও চোরাকারবারীদের এক বিশাল সিন্ডিকেট। এবং রাতারাতি ফিল্মের খলনায়কদের মত তিনি বনে যান চোরাকারবারীদের গডফাদার।

 

জৈন্তাপুর উপজেলার হরিপুর গ্রামের সাবেক মেম্বার আব্দুল খালিকের পুত্র আবুল হোসেন। তিনি সিলেটের জৈন্তাপুর ও হরিপুর এলাকার চোরাকারবারিদের গডফাদার নামে পরিচিত ।

 

অনুসন্ধানে জানা যায়, এমন কোনো ভারতীয় অবৈধ পণ্য নেই যা আবুল ও তার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে সিলেট শহরে প্রবেশ করছে না।

 

বর্তমানে আবুল হোসেনের চোরাচালানের প্রধান দ্রব্য হচ্ছে ভারতীয় চিনি সিলেটের তামাবিল সড়ক কোন পথে আবুল হোসেন ও তার সিন্ডিকেটের সদস্য দ্বারা প্রতিরাতেই প্রশাসনের নাকের ডগা দিয়ে সিলেট শহরে প্রবেশ করছে শত শত ডিআই পিকাপ ভর্তি ও নৌকা বুঝাই ভারতীয় চিনি।

 

নাম না বলার শর্তে এক ব্যবসায়ী বলেন, আবুল তার ব্যবসা সঠিক রাখতে মাঝে মাঝে প্রশাসনের চাপে অন্য ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন ধরনের ভারতীয় অবৈধ পণ্য পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দেয়।

 

তার সাথে কারো ব্যবসার হিসাবে উনিশ বিশ হলে রাস্তায় বিভিন্ন বাহিনী দিয়ে মাল কখনো লুট করায় কখনো প্রশাসন দিয়ে আটক করায়।

 

ছিপছিপে গড়নের যুবক আবুল হোসেন। বয়স ৩২ কিংবা ৩৬ বছর। সিলেটের হরিপুরে ক্ষমতা ও দাপটের এক জ্বলন্ত উদাহরণ তিনি। বাড়ি হরিপুর বাজারের ব্রিজের কাছে ছিল।

 

ফেরি করে জ্বালানি তেল বিক্রি করার ব্যবসা তাদের দীর্ঘদিনের। এ সময় জাফলং পাথর কোয়ারিতে বোমা মেশিনে ফেরি করে ডিজেল বিক্রি করতো।

 

পারিবারিক দেনার দায়ে এক সময় হরিপুরের বাড়ি বিক্রি করে চলে যান পার্শ্ববর্তী ৭ নম্বর গ্যাস ফিল্ডের উতলার পাড়ে। প্রায় ৫ বছর আগে ঢুকে পড়ে চোরাই লাইনে।

 

সিলেট জেলা পুলিশের ডিবির ওসি ইকবাল হোসেনের সোর্স হিসেবে সীমান্ত দিয়ে চোরাই পথে নিয়ে আসা পণ্যের লাইনের টাকা তুলতো। আর ওই টাকা সে ডিবি ও থানা পুলিশকে দিয়ে নিজের অংশ রেখে দিতো।

 

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, সিলেট জেলা পুলিশের ডিবি উত্তরের তৎকালীন ওসি রেফায়েত চৌধুরীর সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে তার। ডিবি’র ওসির নিজস্ব মানুষ হিসেবে সে চোরাই সাম্রাজ্যে দাপট দেখাতে শুরু করে।

দুই থেকে আড়াই বছর আগে গরু ও মহিষ চোরাচালান থেকে চিনির চোরাচালানে বিভক্ত হন সীমান্তের চোরাকারবারিরা।

এই সুযোগে প্রথমে ডিবির ও পরবর্তীতে পুলিশ, বিজিবি’র একক লাইনম্যান হয়ে যায় আবুল হোসেন। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

 

সিলেটের চিনির কারবারিরা জানিয়েছেন, আবুল তার চৌধুরী এন্টারপ্রাইজের নামে লাইনের রিসিট দিয়ে হরিপুর থেকে গাড়ি ছাড়তো।

 

আর এই এন্টারপ্রাইজের চালান রশিদ গোটা দেশের পুলিশের কাছে পরিচিত ছিল। পরবর্তীতে এলাকার মানুষের প্রতিবাদের মুখে চৌধুরী নাম পরিবর্তন বিজয় নাম পরিবর্তন করে।

 

বর্তমানে বিজয় এন্টারপ্রাইজের নামে রশিদ দিচ্ছে। প্রতিটি গাড়ি থেকে সে লাইনে ৬০ হাজার টাকা নিতো।

কোনো কোনো দিন ২৫০ থেকে ৩০০টি গাড়ি ছেড়েছে। গড়ে প্রতিদিন একশ’র ওপরে চিনিভর্তি গাড়ি হরিপুর ছেড়েছে। এতে দেখা গেছে; ডিবি, পুলিশ ও বিজিবি’র নাম করে প্রতিদিন কোটি টাকার মতো টাকা তুলতো।

আর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নামমাত্র টাকা দিয়ে পুরো টাকাই লুটে নিতো। এভাবে টাকার মালিক হয়েছে আবুল।

 

গত ৫ই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পূর্ব পর্যন্ত আবুল একচেটিয়া লাইনের ব্যবসা করেছে। এ কারণে চিনি ব্যবসায়ীদের ধারণা; আবুল শতকোটি টাকার সম্পদ বানিয়েছে।

 

আর এই টাকা কামিয়ে সে হরিপুরের পার্শ্ববর্তী গ্যাসকূপ এলাকার উতলার পাড়ে ৩-৪ কোটি টাকা খরচ করে অট্টালিকা তৈরি করছে।

 

বাড়ির কাছে শাহ মাদার ফিলিং স্টেশন নামে একটি বন্ধ পেট্রোল পাম্প ছিল। কোটি টাকার ওপরে বিনিয়োগ করে ওই পাম্পের ৬০ ভাগ শেয়ার কিনেছে। ফের চালু করে পাম্পের নিচতলায় নিজের চিনি ব্যবসার অফিস খুলেছে। পাম্পের মালিক আবুল কালাম শেয়ার বিক্রির কথা প্রতিবেদকের কাছে স্বীকার করেছে।

 

এ ছাড়া, বটেশ্বর এলাকার একটি হাউজিং নামে-নামে কোটি টাকা দিয়ে কয়েকটি প্লট, শাহ সুন্দর এলাকার আরেকটি হাউজিংয়ে প্লট ও হরিপুর এলাকায় জমি কিনেছেন আবুল। স্থানীয়রা এসব তথ্য দিয়ে বলেছেন, ঢাকার একটি নামকরা আবাসিক এলাকায় কয়েক কোটি টাকা দিয়ে একটি ফ্লাট কিনেছেন।

 

ঢাকার সম্পদের কথা তিনি তার পরিচিত কয়েকজনের কাছে স্বীকারও করেছেন। পুলিশের এক কর্মকর্তা ওই সম্পদ দেখভাল করেন। বছর খানেক ২২ লাখ দিয়ে নিজের জন্য একটি করোলা ফিল্টার কার কিনেছিল আবুল।

 

ওই কার কিছুদিন ব্যবহারের পর নতুন করে ৪৬ লাখ টাকা খরচ করে করোলা ক্রস নামে আরেকটি গাড়ি কিনেছেন। হরিপুরের স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত এপ্রিল মাসে ডিবির সাবেক ওসি রেফায়েত চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে চট্টগ্রামের একটি শোরুম থেকে এককালীন টাকা দিয়ে ওই গাড়ি কিনেছেন।

 

পুলিশ জানিয়েছে, চিনি চোরাকারবারে লাইনম্যান হওয়ার কারণে বিভিন্ন সময় তার বিরুদ্ধে জৈন্তাপুরসহ নগরের কয়েকটি থানায় মামলা হয়েছে।

 

এর মধ্যে কয়েকটি মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা থাকলেও তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি। গত দু’মাস আগে আবুলকে ধরতে র‌্যাবের একটি টিম হরিপুরের পাম্প এলাকায় অভিযান চালালেও তাকে পায়নি।

২০২২ সালে এক মামলার হাজিরা দিতে গিয়ে সে গ্রেফতার হয়ে ৩ দিন কারাবরণ করেছে। চিনি চোরাচালানের ঘটনায় নাম প্রকাশের পর সিলেটের দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে তাকে নোটিশ প্রদান করেছিল।

পরে পরিচিত পুলিশ কর্মকর্তাকে সঙ্গে নিয়ে ওই নোটিশ তামাদি করতে চেষ্টা চালিয়েছেন বলে তার ঘনিষ্ঠ কয়েকজন ব্যবসায়ী জানিয়েছেন।

আবুল চিনির ব্যবসা করে কেবল সম্পদই গড়েননি, হরিপুরের ঐতিহ্য ভেঙে নানা বেলাল্লাপনায়ও মেতে ওঠেন। কয়েক মাস আগে একটি রিসোর্টে ঢাকা থেকে আনা নারীদের নিয়ে আমোদ-ফুর্তি করেছেন তিনি। আর তার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশ হওয়ায় সিলেটে তোলপাড় শুরু হয়েছে।

এতো কিছুর পরও থেমে নেই আবুল হোসেনের ‘বুঙার’ চিনির ব্যবসা ।

 

প্রসজ্ঞত গতবছর ২০২৩ সালের (১৩ই অক্টোবর) শুক্রবার সিলেটের জৈন্তাপুরে ভারত থেকে একটি ডিআই ট্রাকে আসা চোরাই মালামাল ধরতে উপজেলার হরিপুরে চৌকি বসিয়ে তল্লাশি চালায় সিআইডি টিম।

 

এসময় ধলাই মিয়া (১৯) নামে এক ব্যক্তিকে আটক করা হয়। তাকে ছাড়িয়ে নিতে চোরাকারবারি দলের ৮০/৯০ জন সদস্য সিআইডি সদস্যদের উপর হামলা চালায়।

 

মারপিট করে সিআইডির এক কর্মকর্তার হাত ভেঙে দেয়া হয়। ওই দিন আরেকটি অভিযানে ৯৮০ কেজি ভারতীয় চা পাতা জব্দ করে সিআইডি।

 

এ সময় আজগর নামে আরেক পিকআপ চালককে গ্রেফতার করা হয়। এ ঘটনায় জৈন্তাপুর থানায় পৃথক দু’টি মামলা দায়ের করে সিআইডি। কর্তব্যকাজে বাধা প্রদানসহ হত্যার উদ্দেশ্যে মারপিট করে হ্যান্ডকাপসহ আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার অপরাধে এসআই দ্বীরাজ ধর প্রিন্স বাদি হয়ে জৈন্তাপুর থানায় মামলা দুটি দায়ের করেন।

সেই মামলা দুটির মধ্যে একটি মামলার ৩ ( তিন ) নং আসামী কুখ্যাত চোরাকারবারী আবুল হোসেন ( ৩৫ ) ।

আজ ঐ মামলা দুটির একবছর পূর্ণ হলো । এতো কিছুর পরও থেমে নেই আবুল হোসেনের ‘বুঙার’ চিনির ব্যবসা ।

গত ১৫ দিন পূর্বে আবুল হোসেনের একটি অবৈধ ভারতীয় চিনি ভর্তি ট্রাক দক্ষিন সুরমা এলাকায় কিছু ছিনতাইকারী আটক করে । পরবর্তীতে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ট্রাকটি ছাড়িয়ে আনে আবুল হোসেনে । কিভাবে আইনের শাষনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী প্রদর্শন করে আধিপত্য বিস্তার করে চলেছেন আবুল হোসেন এ প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জৈন্তাপুর ও হরিপুরের স্থানীয় বাসিন্দাদের মাথায়।

বর্তমানে প্রায় প্রতিদিন হচ্ছে অভিযান, ধরা পড়ছে কোটি টাকার চিনি পর্যন্ত। তবু থামছে না সিলেটে চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্য।

ভারতীয় চোরাই চিনি স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সিলেটের চোরাকারবারিরা বেছে নিয়েছেন ট্রাকে বালুর নিচে লুকানোর নতুন কৌশল।

এসব ব্যাপারে কথা হয় আবুল হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান- চিনি’র লাইনে সম্পৃক্ত নয়। পাম্পের শেয়ার কিনে জ্বালানি তেলের ব্যবসা করেন তিনি।

৪ কোটি টাকা দিয়ে বাড়ি নির্মাণ, কয়েক হাউজিংয়ে সম্পদ ক্রয়, গাড়িক্রয়সহ নানা প্রশ্নের উত্তরে আবুল জানিয়েছেন- তিনি কেবল বাড়ি নির্মাণ করছেন।

 

আর অন্য সম্পদ সম্পর্কে তার জানা নেই। একটি কুচক্রী মহল তার বিরুদ্ধে এসব কুৎসা রটিয়ে যাচ্ছে। ঢাকায়ও তার কোনো প্লট কিংবা ফ্লাট নেই বলে দাবি করেন।

আর তার নামে কোনো গাড়িও কিনেনি বলে জানান। কম মূল্যের একটি গাড়ি কিনেছিলেন, সেটি পরবর্তীতে বিক্রি করে দেন।

 

এ ব্যাপারে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ (এসএমপি) কমিশনার মো. রেজাউল করিম (পিপিএম-সেবা) বলেন- সিলেট মহানগরে চিনিসহ চোরাই পণ্যের কারবার ঠেকাতে নিয়মিত কাজ করছে আমাদের পুলিশ।

 

এটি ঠিক যে- চোরাচালান পণ্যের সঙ্গে থাকা বাহকরা ধরা পড়ে, মূল হোতারা বেশিরভাগ  সময় থেকে যায় অন্তরালে।

 

 

তবে মহানগর পুলিশের প্রতি বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে- যেন এখন থেকে সব জব্দ-মামলার তদন্তকালে চোরাচালানের মূল হোতাদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধেও আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।