সুরমা টাইমস ডেস্ক :
সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গত শুক্রবার দুবাই থেকে আসা বিমানের একটি ফ্লাইট থেকে ৯৩৩ গ্রাম ওজনের আটটি সোনার বার জব্দ করেছে কাস্টমস কর্মকর্তারা।
সোনাগুলো বাংলাদেশ বিমানের বিজি-২৪৮ ফ্লাইটে যাত্রীবিহীন একটি সিটের নিচে বিশেষ কৌশলে লুকানো ছিল। জব্দ করা এসব সোনার বাজার মূল্য ১ কোটি টাকা।
এ নিয়ে গত তিন মাসে ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৯টি অভিযানে প্রায় ২১ কেজি ৩৪৬ গ্রাম চোরাই সোনা জব্দ করা হয়।
আর গত ১০ বছরে উদ্ধার হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ মণ সোনা। বর্তমান দর অনুযায়ী এসব সোনার মূল্য প্রায় ২০০ কোটি টাকা।
বিমানবন্দর সূত্র জানায়, ওসমানী বিমানবন্দরে বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য যাত্রীদের দেশে ফেরার সময় ‘টিকিট ফ্রি’ করে দেওয়ার কৌশলে একটি শক্তিশালী সোনা চোরাকারবারি চক্র সক্রিয় রয়েছে।
চক্রটি সংযুক্ত আরব আমিরাত, দুবাই, আবুধাবীসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে সোনা চোরাচালান নিয়ে আসছে। এর মধ্যে সৌদি আরব থেকেও মাঝে মধ্যে সোনার ছোট ছোট চালান আনে।
তবে বেশিরভাগ চালান আসে দুবাই থেকে। যাত্রীবেশে নানান কৌশলে চোরাই সোনা নিয়ে আসা হলেও মূলত দেশ-বিদেশের বিভিন্ন গন্তব্যে পৌঁছানোর লক্ষ্য থাকে।
সেই সব গন্তব্য নির্ণয় না হওয়ায় বন্ধ করা যাচ্ছে না চোরাই সোনার কারবার। এতে করে সোনা চোরাচালানীদের নিরাপদ রুট হয়ে উঠেছে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
সোনা চোরাচালানে গত ১০ বছরের পরিসংখ্যানে বিমানবন্দর কাস্টমস সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ বছরে সব মিলিয়ে জব্দ করা হয়েছে প্রায় সাড়ে চার মণ চোরাই সোনা।
এর মধ্যে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ওসমানী বিমানবন্দর থেকে ১৯ কেজি সোনা জব্দ করেছে কাস্টমস। ২০১৬ সালের ১৭ মার্চ ৫৮০ গ্রাম ওজনের পাঁচটি সোনার বার জব্দ করা হয়। এ ঘটনায় কেউ আটক হয়নি।
গত ২৪শে এপ্রিল এক লন্ডনপ্রবাসীর কাছ থেকে ৪৩২ গ্রাম সোনা জব্দ করে কাস্টমস। পরে ব্যাগেজ রুলস মোতাবেক এর নিষ্পত্তি করা হয়।
গত ১৭ই ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা বিমানে তল্লাশি চালিয়ে ১৬ পিস সোনার বার জব্দ করা হয়, এর ওজন ১ কেজি ৮৭২ গ্রাম। এ ঘটনায় কেউ আটক হয়নি। একই বছরের ১৬ নভেম্বর ৯ কেজি ৩০০ গ্রাম ওজনের ৮০টি সোনার বার জব্দ করা হয়।
বিমানের যাত্রী সিটের নিচে তল্লাশি চালিয়ে এসব সোনা উদ্ধার করা হয়। দুবাই থেকে আসা ওই বিমানের দুটি সিটের নিচ থেকে কাগজে মোড়ানো অবস্থায় সোনার বারগুলো রাখা ছিল। এ ঘটনায়ও কাউকে আটক করা সম্ভব হয়নি।
২০১৭ সালের ২৩শে জুলাই আবুধাবি থেকে আসা বিমানের লাগেজ হোল্ডে অভিযান চালিয়ে ৩ কেজি ৫০০ গ্রাম ওজনের ৩০টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়।
বিমানের ওই ফ্লাইটটি সিলেট হয়ে ঢাকায় ফিরছিল। সোনার চালান ধরা পড়লেও জড়িত কেউ ধরা পড়েনি। ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবি থেকে আসা জাহিদ হোসেন নামে এক যাত্রীর কাছ থেকে ৪ কেজি ৬৪ গ্রাম ওজনের ৪০টি সোনার বার উদ্ধার করা হয়।
২০২০ সালের ১৮ই ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা জামিল আহমদ নামের এক যাত্রীর কাছ থেকে ১৪টি সোনার বার ও কিছু স্বর্ণালংকার উদ্ধার করা হয়, যার ওজন প্রায় দুই কেজি।
একই বছরের ৩রা জানুয়ারি দুবাই দিয়ে আসা একটি ফ্লাইটে তল্লাশি চালিয়ে ৬০ পিস সোনার বার উদ্ধার করে কাস্টমস; ওজন প্রায় ৭ কেজি।
এ ঘটনায় বাংলাদেশ বিমানের মেকানিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট কামরুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।
করোনা মহামারির সময় পেরিয়ে ২০২১ সালের ২৭ ডিসেম্বর ৭ কোটি টাকা মূল্যের ১১ কেজি ২২০ গ্রাম চোরাই সোনাসহ দুবাই থেকে আসা চার যাত্রীকে আটক করে কাস্টমস।
চার যাত্রী ব্লেন্ডার ও আয়রন মেশিনের ভেতরে কৌশলে এই সোনা নিয়ে আসেন। ওই বছরের ৮ই নভেম্বর দুবাই ফেরত যাত্রী নরেন্দ্র নাথের কাছ থেকে ৬ কেজি ১৪৮ গ্রাম ওজনের ৩৮ পিস সোনার বার উদ্ধার করা হয়।
২০২২ সালের জুন মাসে পাঁচ দিনের ব্যবধানে দুটি সোনা চোরাচালান ধরা পড়ে।
২৭শে মে আলী আহমদ নামে এক যাত্রীর কাছ থেকে জব্দ করা হয় ১ কেজি ১৬০ গ্রাম সোনা। আর ২ জুন দুবাইফেরত যাত্রী ময়নুল ইসলাম শাকিলের কাছ থেকে সমপরিমাণ সোনা উদ্ধার হয়।
২০২৩ সালের ৮ই ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিমানের বিজি-২৪৮ নম্বর ফ্লাইটের চার যাত্রী ও বিমানের টয়লেট থেকে ৩২ কেজি ৬৫ গ্রাম ওজনের ২৮০টি বার ও দেড় কেজি ওজনের ৬টি লিকুইড গোল্ড জব্দ করে কাস্টমস।
এ ঘটনায় জড়িত বিমানের ৪ যাত্রী হাবিবুর রহমান (৩৮), ম. সানু মিয়া (৩৫), মো. আক্তারুজ্জামান (৪০) ও মিসফা মিয়াকে (৪৯) গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে এয়ারপোর্ট থানায় চোরাচালান আইনে মামলা করা হয়।
২০২৪ সালের ২৮শে আগস্ট সকালে শারজাহ থেকে বিমানের বিজি-২৫২ ফ্লাইটে আসা যাত্রী সিলেটের বাসিন্দা হোসাইন আহমদের লাগেজে তল্লাশি চালিয়ে ১৫ কেজি ৯১৫ গ্রাম ওজনের চোরাই সোনা জব্দ করা হয়।
গত ৪ঠা ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা বিমানের বিজি-২৪৮ ফ্লাইটে ১ কেজি ২৮৩ গ্রাম ওজনের ১১টি সোনার বার উদ্ধার হয়। পরে ৬ই ডিসেম্বর দুবাই থেকে আসা একই ফ্লাইটে পরিত্যক্ত অবস্থায় সিটের নিচ থেকে ১ কেজি ২০০ গ্রাম ওজনের সোনা উদ্ধার করা হয়।
চলতি বছর ৬ই ফেব্রুয়ারি ওসমানী বিমানবন্দরে দুবাই থেকে আসা দুই যাত্রীর কাছ থেকে সাড়ে ১৭ কেজি সোনা জব্দ করে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা- এনএসআই।
যার বাজার মূল্য প্রায় ২০ কোটি ২৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা। এ ঘটনায় মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার রকমপুর গ্রামের সায়েদ আহমদ (২৪) ও সিলেটের জৈন্তাপুর উপজেলার দরবার পূর্ববাইট গ্রামের আফতাব উদ্দিনকে (৩৬) গ্রেপ্তার করা হয়।
অভিযানসংশ্লিষ্টরা বলছেন, গ্রেপ্তার হওয়া দুজন সোনা চোরাচালানের বাহক। তবে তাদের কাছ থেকে চক্রের সন্ধান মেলবে।
সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এয়ারপোর্ট থানার অধীন সিলেট এম এ জি ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর।
এব্যাপারে এয়ারপোর্ট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সৈয়দ আনিসুর বলেন, ‘সোনাসহ গ্রেপ্তার দুজনকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ জন্য আদালতে রিমান্ডের আবেদনও জানানো হয়েছে।
জিজ্ঞাসাবাদে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া যেতে পারে। এসব তথ্য পেলে সোনা চোরাকারবারিদের ধরতে পুলিশ মাঠে কাজ করবে।’