সুরমা টাইমস ডেস্ক : বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সেন্টার দিল্লি থেকে সরিয়ে ঢাকায় অথবা প্রতিবেশী অন্য কোনো দেশে স্থানান্তরের জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতিকদের অনুরোধ জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল দুপুর ১২টায় রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে কূটনীতিকদের সঙ্গে এক বৈঠকে এ অনুরোধ জানান তিনি। আড়াই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে কূটনীতিকদের ১৯ সদস্যের প্রতিনিধিদলটির নেতৃত্বে ছিলেন- বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) হেড অব ডেলিগেশন মাইকেল মিলার। বৈঠকে অংশ নেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ভারত বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা সীমিত করায় অনেক শিক্ষার্থী দিল্লি গিয়ে ইউরোপের ভিসা নিতে পারছেন না। ফলে তাদের শিক্ষাজীবন নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বাংলাদেশের শিক্ষার্থী পাচ্ছে না। ভিসা অফিস ঢাকা অথবা প্রতিবেশী কোনো দেশে স্থানান্তর হলে বাংলাদেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন উভয়ই উপকৃত হবে। তিনি বলেন, ডিসেম্বরে গোটা মাসজুড়ে আমরা বিজয় উদ্যাপন করি। বিজয়ের মাসে আপনাদের সঙ্গে এমন একটি ইন্টার্যাক্টিভ আলোচনায় অংশ নিতে পেরে আমি খুব আনন্দিত। বাংলাদেশে জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন তিনি। এ সময় তিনি গত ১৬ বছর ধরে অত্যাচার, শোষণ, বলপূর্বক গুম, মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে সংক্ষেপে তুলে ধরেন। তিনি অর্থনৈতিক শ্বেতপত্রের বিষয় উল্লেখ করে দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং ব্যাংকিং সিস্টেমকে কীভাবে বিপর্যস্ত করা হয়েছিল সেসব কথা জানান। বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্যাপক আকারে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা এই মিসইনফরমেশন ঠেকাতে আপনাদের সহযোগিতা কামনা করি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে দেশ থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হওয়া স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা ও তার সহযোগীরা যে ব্যাপক টাকা পাচার করে নিয়ে গেছে, তা দিয়ে তারা দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে বলেও জানান তিনি। সমপ্রীতি ও জাতীয় ঐক্যের লক্ষ্যে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দল ও ধর্মীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময়ের কথাও বৈঠকে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টা। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সংস্কার ও নির্বাচন প্রক্রিয়া সম্পর্কেও ইইউ প্রতিনিধিদের বিশদভাবে জানিয়েছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে উপস্থিত পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন জানান, ইতিমধ্যে বুলগেরিয়া বাংলাদেশিদের জন্য তাদের ভিসা সেন্টার ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনামে স্থানান্তর করেছে। তিনি অন্য দেশগুলোকেও একই প্রক্রিয়া অনুসরণের আহ্বান জানান। সংস্কার প্রক্রিয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন ইইউ প্রতিনিধিরা। পরামর্শ ও সুপারিশ জানিয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতিও দেন তারা। প্রায় আড়াই ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠকে ১৫ জন প্রতিনিধি তাদের মতামত তুলে ধরেন। বৈঠকে শ্রম অধিকার, বাণিজ্য সুবিধা, জলবায়ু পরিবর্তন, মানবাধিকার, ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বাস্তবায়ন ও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে উভয়ের অঙ্গীকার ও করণীয় সম্পর্কে আলোচনা হয়েছে। এদিকে সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বৈঠকের বিষয়ে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক উপদেষ্টা ড. সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বাংলাদেশ এখন স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণ ঘটাবে। সেক্ষেত্রে আমাদের কিছু বাণিজ্য সুবিধা ইউরোপিয়ান বাজারে প্রাপ্তির ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন ও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তারা মানবাধিকার, নির্বাচন ও শ্রমিক অধিকার নিয়ে বলেছেন। আমরা জানিয়েছি প্রত্যেক বিষয়ে প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। আমরা একটি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক নির্বাচনের দিকে যাবো। আমরা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিষয়ে জানিয়েছি। তিনি বলেন, সংস্কার বিষয়ক কমিশনগুলো কীভাবে কাজ করছে সে বিষয়ে জানিয়েছি। তারা শ্রম অধিকার নিয়ে জানতে চেয়েছেন। আমরা জানিয়েছি একটা কমিশন হয়েছে। কম দামে মজুরির যে বিষয়টি বলা হয় সেটা যেন আমাদের আর না শুনতে হয়। বরং শ্রমিক স্বার্থ যেন সুসংহত থাকে সেটি কমিশনের মতামতের ভিত্তিতে আমরা ব্যবস্থা নেবো। রিজওয়ানা হাসান বলেন, বাংলাদেশি নাগরিকদের ইউরোপিয়ান দেশে যেতে ভিসার জন্য আবেদন করতে হয় দিল্লি থেকে। এটা অনেক সময় ঝামেলা হয়ে যায়। তাদের কাছে অনুরোধ ছিল তারা যেন এ ভিসা সেন্টারগুলো দিল্লি থেকে সরিয়ে অন্যত্র স্থাপন করেন। তিনি বলেন, বিভিন্ন ইস্যুতে যে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে তার বিষয়ে বলা হয়েছে। কেন জুলাই এর বিপ্লব হলো, বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষা কী, আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে জাতীয় ঐক্য গড়ার যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে বিভিন্ন বিষয়ে সেটার বিষয়েও জানানো হয়েছে। এছাড়া জুলাই-আগস্টে যে হত্যাকাণ্ড হয়েছে সেটি ও হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য যে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে সে বিষয়ে বলা হয়েছে। বৈঠকে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রদূতরা হলেন- বাংলাদেশে নিযুক্ত ডেনমার্কের রাষ্ট্রদূত ক্রিশ্চিয়ান ব্রিক্স মোলার, ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত ম্যারি মাসদুপুই, জার্মানির রাষ্ট্রদূত আচিম ট্রস্টার, ইতালির রাষ্ট্রদূত আন্তোনিও আলেসান্দ্রো, স্পেনের রাষ্ট্রদূত গ্যাব্রিয়েল সিস্তিয়াগা ওচোয়া ডি চিনচেত্রু, সুইডেনের রাষ্ট্রদূত নিকোলাস উইকস, ইইউ ডেলিগেশনের প্রধান ও রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার, ঢাকাস্থ নেদারল্যান্ডস দূতাবাসের সিডিএ এআই আন্দ্রে কার্সটেন্স। নয়াদিল্লিতে ইইউ মিশনের প্রধান/প্রতিনিধিরা হলেন- বেলজিয়ামের রাষ্ট্রদূত দিদিয়ের ভ্যান্ডারহাসেল্ট, বুলগেরিয়ার রাষ্ট্রদূত নিকোলাই ইয়ানকভ, এস্তোনিয়ার রাষ্ট্রদূত মারজে লুপ, লুক্সেমবার্গের রাষ্ট্রদূত পেগি ফ্রান্টজেন, স্লোভাকিয়ার রাষ্ট্রদূত রোবার্ট ম্যাক্সিয়ান, সাইপ্রাসের মনোনীত হাইকমিশনার এভাগোরাস ভ্রিওনাইডস, নয়া দিল্লিতে হাঙ্গেরি দূতাবাসের ঢাকা অফিসের প্রথম সচিব গ্যাবর জুকস, নয়া দিল্লিতে পোল্যান্ড দূতাবাসের কাউন্সেলর জারোস্লাভ জেরজি গ্রোবেরেক, পর্তুগাল দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন সোফিয়া বাতালহা, স্লোভেনিয়া দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি ইরমা সিনকোভেক, রোমানিয়া দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব রুক্সান্দ্রা সিওকানেলিয়া।