ধ্বংসের মুখে সিলেটের ‘শ্রীশ্রী নৃসিংহ জিউর আখড়া’

সজল ঘোষঃ

সিলেট নগরের কালিঘাটস্থ ‘শ্রীশ্রী নৃসিংহ জিউর আখড়া’ জরাজীর্ণ অবস্থায় প্রায় ধ্বংসের মুখে। আখড়াটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে সংস্কারের অভাবে এই করুণ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দায়িত্বহীনতার কারণে আখড়াটির সংস্কার ও আধুনিকায়নের কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না।

এজন্য সনাতন ধর্মাবলম্বী ভক্ত-অনুরাগীদের মনে চরম ক্ষোভ ও হতাশা বিরাজ করছে। ‘শ্রীশ্রী নৃসিংহ জিউর আখড়া’ সংস্কার ও আধুনিকায়ন করার জন্য সনাতন ধর্মাবলম্বী ভক্ত-অনুরাগীরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

জানা যায়, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ১৪নং ওয়ার্ডের কালীঘাট এলাকায় ভক্তবৎসল ভগবান শ্রীশ্রী নৃসিংহ জিউর আখড়াটি অবস্থিত। জনশ্রুতি রয়েছে-এই আখড়াটি প্রাচীনকালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। একসময় এই আখড়ায় প্রতিদিন পূজার্চ্চনা হতো। অসংখ্য ভক্ত-অনুরাগীর পদচারণায় মুখর থাকতো এই আখড়া প্রাঙ্গণ। কালের বিবর্তনে আজ আখড়াটির সেই জৌলুস নেই। নেই ভক্ত-অনুরাগীদের সরব উপস্থিতি।

অনেকদিন ধরে সংস্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে আখড়াটি আজ জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই নাটমন্দিরে পানি গড়িয়ে পড়ে। দেয়ালের পলেস্তেরা খসে পড়ছে। যে কোনো সময় এই আখড়াটি একেবারেই অনুপোযোগী হতে পারে বলে অনেকেই আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।

জানা গেছে, প্রায় ১৬-১৭ বছর আগে আখড়াটি সংস্কারের জন্য ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল। এরপর এই কাজের আর অগ্রগতি হয়নি। আখড়াটি পরিচালনার জন্য কোনো কমিটিও নেই বলে জানা গেছে। বর্তমানে আখড়াটির অনেক জায়গা-সম্পত্তি ভূমিখেকো চক্র জোরপূর্বক দখল করে রেখেছে।

একটি সূত্র জানায়, শ্রীশ্রী নৃসিংহ জিউর আখড়াটির সংস্কার ও উন্নয়ন করার জন্য ৪ বছর আগে একটি ‘উন্নয়ন কমিটি’ গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটির সভাপতি ছিলেন অ্যাডভোকেট গৌতম দাস ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন প্রকৌশলী গৌতম দে। তারপর সেই কমিটি কাজের কাজ কিছুই করেনি।

জানা গেছে, নানা জটিলতায় সেই কমিটি শতভাগ ব্যর্থ হয়। নৃসিংহ জিউর আখড়ার কাছ থেকে ১২ জন ব্যক্তি ১২টি দোকান ও গুদামঘর ভাড়া নেন।

অথচ মাত্র ২ জন প্রতি মাসে ভাড়া পরিশোধ করে আসছেন। বাকি ১০ জন ভাড়া না দিয়ে জোরপূর্বক দখল করে আছে দোকান ও গুদামঘর। বর্তমানে আখড়াটিতে ১৫ শতক জায়গা দখলে রয়েছে বলে জানা গেছে।

এই প্রাচীন আখড়াটির পাশেই শ্রীশ্রী দক্ষিণেশ্বর কালীমন্দির, শ্রীশ্রী জগন্নাথদেবের মন্দির ও দেবাদিদেব মহাদেবের প্রাচীন মন্দির রয়েছে। শ্রীশ্রী নৃসিংহ জিউর আখড়ায় ‘যমুনা’ নামে একজন বয়ষ্ক বৈষ্ণবী রয়েছেন। যিনি তার সামর্থ্য অনুযায়ী কোনোমতে শ্রীশ্রী নৃসিংহদেবের পূজার্চ্চনা করে আসছেন।

 

আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ ইসকন বাংলাদেশের সহ-সভাপতি ও ইসকন সিলেটের অধ্যক্ষ শ্রীমৎ ভক্তিঅদ্বৈত নবদ্বীপ স্বামী মহারাজ বলেন, ‘ভগবানের আখড়াকে অসুন্দর করে রাখার কোনো মানে হয় না। পবিত্র আখড়াকে প্রতি মুহূর্তে দৃষ্টিনন্দন ও সুন্দর রাখা আমাদের সবার নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।

সিলেটের শ্রীশ্রী নৃসিংহ জিউর আখড়াটির জায়গা-সম্পত্তি উদ্ধার করা হোক ও আখড়াটি সংস্কার করে সুন্দর করে রাখা হোক। এই দাবি আমাদের সকলের প্রাণের দাবি।’

বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সিলেট জেলা শাখার সভাপতি শ্রী প্রদীপ কুমার ভট্টাচার্য্য বলেন, ‘সিলেট নগরের শ্রীশ্রী নৃসিংহদেবের আখড়াটি সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা সময়ের দাবি। প্রাচীন এই আখড়াটিকে রক্ষার জন্য আমাদের সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংস্কার ও আধুনিকায়ন করতে হবে। ধর্মীয় পবিত্র স্থানটিকে সকলে মিলেমিশে নান্দনিক সুন্দর করার উদ্যোগ নেয়া দ্রুত প্রয়োজন।’

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৮নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি জগদীশ চন্দ্র দাস বলেন, ‘সিলেট নগরের শ্রীশ্রী নৃসিংহ দেবের আখড়াটির উন্নয়ন-অগ্রগতির কাজ কেন গ্রহণ করা হচ্ছে না।

ভগবান নৃসিংহদেবের এই পবিত্র ধর্মীয় স্থানটি কেন বছরের পর বছর ধরে অযতœ-অবহেলায় রাখা হচ্ছে। এখন সময় এসেছে সবার সম্মিলিত উদ্যোগে এই আখড়াটির উন্নয়ন কাজ এগিয়ে নেয়ার। দখলমুক্ত করতে হবে আখড়ার সকল সম্পত্তি। সবার সুন্দর চিন্তা ও পরিশ্রমে আখড়াটির উন্নয়ন-অগ্রগতিতে নিরলস ভূমিকা রাখতে হবে। সুতরাং সময়ের এই দাবি মেনে নেয়া হোক। শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।’

 

সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ১৪নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. নজরুল ইসলাম মুনিমের সাথে এই প্রতিবেদক মোবাইল ফোনে বারবার যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার মোবাইল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ সিলেট মহানগর শাখার সভাপতি রজত কান্তি গুপ্ত বলেন, ‘বাংলাদেশে দেবোত্তর সম্পত্তি সংরক্ষণ আইন চালু না থাকায় সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মন্দির, দেবালয়-এর সম্পত্তি জোরপূর্বক দখল করে নিচ্ছে দুর্বৃত্তরা।

 

এরই ধারাবাহিকতায় সিলেট নগরের কালিঘাটস্থ ‘শ্রীশ্রী নৃসিংহ জিউর আখড়া’ জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে এবং অনেক সম্পত্তি দখল হয়েছে। এই বেআইনী কাজ মেনে নেয়া যায় না। নৃসিংহদেবের আখড়াটি সংস্কার ও আধুনিকায়ন করা এখন সময়ের দাবি।’

নৃসিংহ জিউর আখড়াটির সেবায়িত আ্যডভোকেট গৌতম দাস বলেন, ‘আমি সকল সময় চেষ্টা করছি এই আখড়াটি সংস্কার করার ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করার। এক্ষেত্রে আমার আন্তরিকতার শেষ নেই। নানা সীমাবদ্ধতার কারণে নৃসিংহ জিউর আখড়াটি সংস্কার করা যাচ্ছে না। উন্নয়ন-অগ্রগতির কাজ থমকে আছে।’

তিনি বলেন, ‘সনাতন ধর্মের যে কেউ উদ্যোগ নিয়ে কাজ শুরু করলে তাকে আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো। আমি চাই, নৃসিংহ জিউর আখড়াটি সংস্কার ও আধুনিকায়ন হোক।’

শ্রীশ্রী নৃসিংহদেবের আখড়ার পূজারী বৈষ্ণবী যমুনা বলেন, ‘ভক্তবৎসল ভগবান শ্রীশ্রী নৃসিংহদেবের এই আখড়াটি দীর্ঘদিন ধরে চরম অযত্ন অবহেলায় জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। আমি দ্রুত এই আখড়াটির সংস্কার দাবি করছি। ভগবানের মন্দির সুন্দর রাখলে আমাদের সবার মঙ্গল হবে।’

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।