সুরমা টাইমস ডেস্ক :
সংরক্ষণের অভাবে সিলেটের প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে পরিচিত আসাম স্থাপত্যরীতির স্থাপনাগুলো একে একে হারিয়ে যাচ্ছে।
ছোট ছোট ইট, ইটের সুরকি ও চুন মিশিয়ে তৈরি এসব স্থাপনাগুলোর দেয়াল এবং কাঠ বা লোহার কড়ি-বর্গার উপর সুরকি-চুনের ঢালাই দিয়ে নির্মিত হতো পাকা বাড়ি। অতিবৃষ্টির জন্য অনেক সময় এসব ঘরের উপরে টিনের চাল দেওয়া হতো।
বহু ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনন্য জনপদ সিলেটের অবস্থান বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব দিকে। সিলেটের ঠিক পূর্বেই পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের আসাম। একটা সময় সিলেট অঞ্চল আসামভুক্ত ছিল।
ফলে একই ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এ দুই জনপদের মানুষ বেড়ে উঠেছেন। সিলেট অঞ্চলের ‘আসাম-আদলের বাড়ি’গুলো সেই ঐতিহ্যিক পরম্পরাই যেন বহন করে চলেছে।
আসাম-আদলে বাড়িগুলো একেবারেই সিলেট ও আসাম অঞ্চলের স্থানীয় স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন। ১৮৯৭ সালে আসাম তথা সিলেট অঞ্চলে ভয়াবহ ভূমিকম্পের পর অনেক প্রাসাদ বিধ্বস্ত হলেও আসাম-আদলের বাড়িগুলো খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।
এরপর থেকে সিলেট অঞ্চলে এমন স্থাপত্যধারার বাড়ি নির্মাণ ক্রমে বাড়তে শুরু করে। আধুনিক চাকচিক্যময় বহুতল ভবনের বিপরীতে এখনো সিলেট অঞ্চলের অনেক মানুষ এমন ধরনের ঘর নির্মাণ করে থাকেন।
যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী সাহিত্যিক ও আলোকচিত্রী আনোয়ার ইকবালের ‘আসাম বাড়ি’ শিরোনামে একটা লেখা মুদ্রিত হয়েছে শামছুল মজিদ চৌধুরী সাকির আসাম টাইপ ইউনিক হেরিটেজ হাউজেস ইন সিলেট (জানুয়ারি, ২০২২) শীর্ষক বইয়ে।
এতে তিনি জানিয়েছেন, ইঙ্গ-বর্মা যুদ্ধে জয়লাভের পর ১৮২৬ সালে ইংরেজরা আসামে প্রশাসনিক অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী হয়।
তখন মোগলদের উদ্ভাবিত প্রাসাদ স্থাপত্যের বিপরীতে ইংরেজরা আসামের প্রকৃতি, পরিবেশ ও আবহাওয়া অনুসারে একটি নতুন স্থাপত্যধারা তৈরি করে। এসব স্থাপত্যই পরে ‘আসাম টাইপ হাউস’ হিসেবে পরিচিতি পায়।
গবেষকদের তথ্যমতে, ১৯২০ থেকে ১৯৬০ সালের মধ্যে সিলেট অঞ্চলে আসাম-আদলে বাড়ি সবচেয়ে বেশি নির্মিত হয়েছে।
বাংলো-জাতীয় এমন বাড়ি নির্মাণে বাঁশ কিংবা কাঠের ব্যাটন ব্যবহার করা হতো। ফলে এসব বাড়ি ‘বাংলা ব্যাটন স্টাইল’ নামেও পরিচিতি অর্জন করে।
এসব বাড়ি নির্মাণে একসময় বাঁশ, কাঠ, নলখাগড়া, মাটি ও চুন ব্যবহার করা হলেও সময়ের পরিক্রমায় টিন, ত্রিকোণাকৃতির লোহার বার আর চুন–সুরকি ব্যবহৃত হয়।
এরপর ইট, পাথর, বালু ও সিমেন্টের ব্যবহারও শুরু হয়। ধীরে ধীরে দোতলা আসাম-আদলে বাড়িও নির্মিত হতে থাকে।
শামছুল মজিদ চৌধুরী সিলেটের চৈতন্য প্রকাশন থেকে প্রকাশিত তাঁর আসাম টাইপ ইউনিক হেরিটেজ হাউজেস ইন সিলেট বইয়ে জানিয়েছেন, এসব বাড়ি অনেক বেশি পরিবেশবান্ধব ও আরামপ্রদ।
ভেতরের পরিবেশ শীতকালে উষ্ণ এবং গ্রীষ্মকালে শীতল থাকে। এসব বাড়িতে বায়ুরন্ধ্র (ভেন্টিলেশন) থাকার কারণে অবাধে বায়ু চলাচলের সুযোগ থাকে।
ফলে কখনো দেয়াল ভেজা বা স্যাঁতসেঁতে হয় না। কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কম হয়, বিশেষ করে মানুষের প্রাণহানির আশঙ্কা অনেক কম থাকে।
সিলেট শহরের কাষ্টঘর, হাওয়াপাড়া, চালিবন্দর, তাঁতীপাড়া, শাহি ঈদগাহ, আম্বরখানা, বিমানবন্দর সড়ক, দরগাগেটসহ বিভিন্ন এলাকায় এখনো অসংখ্য আসাম-আদলে বাড়ি দেখা যায়। এর বাইরে বৃহত্তর সিলেটের চার জেলার বিভিন্ন গ্রামেও এমন বাড়ির সন্ধান মেলে।
সিলেটের গোলাপগঞ্জের রনকেলি নুয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা ও ব্যাংক কর্মকর্তা সাদ আহমদ চৌধুরী জানালেন, ১৯৩০ সালে তাঁর দাদা খান বাহাদুর মোহাম্মদ চৌধুরী প্রায় ৮ হাজার বর্গফুট জায়গার ওপর আসাম-আদলে বাড়ি বানিয়েছিলেন। এখনো তাঁরা ওই বাড়িটিতে বসবাস করছেন, কেবল কয়েক দফা সংস্কার করতে হয়েছে।
আসাম আদলের বাড়িগুলোর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে বলছিলেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কৌশিক সাহা।
তাঁর মতে, আসাম আদলের বাড়িগুলো বৃহত্তর সিলেট ও আসামের নিজস্ব স্থাপত্যরীতি। সিলেট ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা, তাই এসব বাড়ি এখানে একসময় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়।
১৮৫০ সালে ইউরোপীয় মিশনারিরা তিন একর জায়গাজুড়ে ভবনটির নির্মাণ শুরু করেন। এটি দুইটি বিশ্বযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের সময়ের নানা ইতিহাস বহন করলেও, ২০২৪ সালে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট সিলেট জেলা হাসপাতাল নির্মাণের জন্য ঐতিহ্যবাহী এই ভবনটিও ভেঙে ফেলা হয়।
নগরীর চৌহাট্টায় অবস্থিত সিংহবাড়িও একটি প্রাচীন আসাম প্যাটার্নের স্থাপনা ছিল। এই বাড়িতে একসময় পদার্পণ করেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বহু গুণীজন। তবে এই বাড়িটির শুধু সামনের অংশটি অক্ষত রেখে মূল বাড়ি ভেঙে ফেলা হয়েছে।
এছাড়া জকিগঞ্জ উপজেলার চারিগ্রামে রয়েছে সাজিদ রাজার বাড়ি, যেখানে তেরো চালা ঘর ও চুনসুরকির কারুকাজে তৈরি কাঠ-বাঁশের স্থাপনাটি এখন ধ্বংসের মুখে।
কামালপুর গ্রামে রয়েছে এমএ হকের পৈতৃক ভিটাও, যা সতেরো শতকের শেষ দিকে নির্মিত হয়েছিল। এসব স্থাপনার অনেকগুলোই বর্তমানে সংরক্ষণের অভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত।
মূলত বাংলা ও আসাম অঞ্চলের লোকজ স্থাপত্যের সঙ্গে ব্রিটিশদের কিছু কারিগরি প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাড়িগুলো তৈরি করা হয়েছিল।
সেমিপাকা আসাম প্যাটার্নের বাড়ির নির্মাণশৈলী এখনো আকর্ষণীয় বলে মনে করেন স্থপতি রাজন দাশ। তিনি বলেন, যদিও সিলেট একসময় আসাম প্রদেশের সঙ্গে ছিল, এ জন্যই আমরা এই ধরনের বাড়িকে আসাম প্যাটার্ন বাড়ি বলি। কিন্তু সিলেট অঞ্চলের বাড়িগুলো আসাম থেকেও কিছুটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত বলেই আমরা একে সিলেট প্যাটার্ন বা সিলেটি বাড়ি বলতে পারি। তৎকালীন আসামের উঁচু অঞ্চলগুলোতে এ ধরনের বাড়ি তৈরি করা হতো।
কোনো কোনো বাড়ি টিলার ওপরে মাচা করেও বানানো হতো, যাতে পাহাড় বেয়ে নেমে-আসা পানি ঘরের নিচ দিয়ে চলে যায়। ইংল্যান্ডে প্রথম করোগেটেড আয়রন শিট বা সিআই শিট তৈরি হয়, যা ব্রিটিশ উপনিবেশ দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ভারতীয় অঞ্চলে আসে, মূলত মাইনিং এরিয়াগুলোর পাশে ওয়্যার হাউসের জন্য এই সিআই শিট ব্যবহৃত হতো। ক্রমশ তা এ অঞ্চলের কুঁড়েঘরের ছাদ হিসেবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে।
ভিত্তি হিসাবে লোহার খুঁটি আর দেয়ালগুলোতে কাঠের ফ্রেম (যাকে আমরা ব্যাটন বলি) ও তার ভেতরে মাটি-লেপা ‘ইকরা’র বেড়ার ব্যবহার শুরু হয়। স্থাপত্যকলায় একে বাংলা ব্যাটন বাড়ি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
ভূমিকম্প সহনশীল কাঠামো ও সহজলভ্য উপাদানের ব্যবহার করায় আসাম–আদলে বাড়িগুলো অনেক টেকসই ও পরিবেশবান্ধব।
অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে সিলেটের এ বিশেষ ঐতিহ্য হুমকির মুখে। স্থপতি রাজন দাশ বলেন, আমার জানামতে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্য বিভাগের অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী ব্রিটিশ পিরিয়ডের স্থাপত্য-আঙ্গিক নিয়ে গবেষণা করছেন,
তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে, ওই সময়ের স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যগুলোকে চিহ্নিত করা এবং ড্রইংয়ের মাধ্যমে সংরক্ষণ করা। যাতে পরবর্তী প্রজন্মের স্থাপত্য শিক্ষার্থীদের এই বিষয়ে জানানো যায়।
আমি মনে করি, এই ধরনের বাড়িগুলো আমাদের এই অঞ্চলের স্থাপত্য-ঐতিহ্যের তথা ইতিহাসের অংশ। যেগুলো এখনো দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোকে ঐতিহ্য ঘোষণা করে সংরক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা অতি জরুরি।