তিন খলিফার একই বেশ লুটেপুটে জাফলং শেষ

সুরমা টাইমস রিপোর্ট :: জাফলং পর্যটন (ইসিও) এলাকা বিএনপির নাম ভাঙ্গিয়ে খাবলে খাচ্ছে বিএনপির কয়েকজন নেতা নিরব ভুমিকায় প্রশাসন এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। গুটিকয়েক অসাধু পাথর খেকোর কারণে জাফলং হারাচ্ছে অপরূপ সুন্দর্য। পরিবেশ ও পর্যটনকেন্দ্র রক্ষায় দীর্ঘদিন থেকে পাথর উত্তোলন বন্ধের সুযোগে স্থানীয় উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করে স্থানীয় বিএনপি নেতা শাহপরান ও স্বপন একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলে অবৈধ ভাবে পাথর-বালু উত্তোলন করছে বলে একাধিক সুত্র জানিয়েছে।
জাফলংয়ের (ইসিএ) আওতাভূক্ত এলাকায় হাইকোর্টের নির্দেশনা অমান্য করে যান্ত্রিক পদ্ধতিতে পাথর ও বালু উত্তোলনের হিড়িক চলছে। অবৈধভাবে পাথর উত্তোলনে জাফলং নদীর তলদেশের ৫০ থেকে ৬০ ফুট গভীর থেকে তোলা হচ্ছে পাথর। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায় ফোর, সিক্স, এইট, টেন সিলিন্ডার মেশিন। প্রতিটি মেশিনই ভয়ঙ্কর। মাটির উপরের অংশ ভেদ করে নিচ থেকে পাথর তোলে এই মেশিনগুলো।

একসময় এসব বোমা মেশিন তান্ডব চালিয়েছিল জাফলং পাথর কোয়ারিতে। প্রায় দেড় যুগ আগের এই তান্ডবের ক্ষতচিহ্ন পূরণ করতে সময় লেগেছিল অন্তত ১২ বছর। বিগত সরকারের সময় প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে জাফলং লুট ঠেকানো সম্ভব হয়েছিল।

কিন্তু ৫ই আগস্টের প্রেক্ষাপটের পর আর সম্ভব হয়নি। প্রথমে হাত দিয়ে, পরে শ্যালো মেশিনসহ নানা মেশিন দিয়ে কোয়ারির উপরের অংশ লুট করা হয়েছে। এখন আর উপরের অংশে বালু কিংবা পাথর নেই। সর্বশেষ প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে জাফলংয়ে এখন বসানো হয়েছে বোমা মেশিন। এই মেশিনের নাম শুনলেই আঁতকে উঠেন জাফলংবাসীও। বোমা মেশিনের তান্ডবে একসময় ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল জাফলংয়ের বুক।

পাথর ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- বোমা মেশিনের বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। ওরা মাটির গভীর থেকে পাথর তুলে আনে। এতে করে গভীরে ক্ষত দেখা দেয়। তৈরি হয় চোরাবালির। জাফলংয়ের মানচিত্রেরও পরিবর্তন ঘটে। যেটি ২০০৫ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তান্ডবে ঘটিছিল। আরেক যন্ত্রদানবের নাম হচ্ছে এক্সেভেটর। এই এক্সেভেটর দিয়ে ৩০ ফুট পর্যন্ত গভীর খনন করা যায়।
বর্তমানে অন্তত ৫টি স্থানে এই মেশিন দিয়ে বড় বড় গর্ত করে পাথর লুট করা হয়েছে। ৫ই আগস্টের দিন বিকালে পতিত শেখ হাসিনা সরকারের পতনে দেশ জুড়ে উল্লাস চলছে। কিন্তু জাফলংয়ে উল্লাসের পরিবর্তে শুরু হয় লুটপাট। জিরো পয়েন্টসহ গোটা কোয়ারির উপরিভাগে থাকা অন্তত দেড়শ’ কোটি টাকার পাথর মাত্র তিনদিনের ব্যবধানে লুট করা হয়। পরবর্তীতে সেনা হস্তক্ষেপে লুটপাট বন্ধ হয়েছিল। ওই সময় প্রশাসনের তরফ থেকে সমীক্ষা চালিয়ে বলা হয়েছিল প্রায় ১২৫ কোটি টাকা পাথর লুট করা হয়েছে। যে পাথরের কোনো ট্যাক্সই সরকার পায়নি। লুটের ঘটনায় পরিবেশ থেকে দুটি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলায় জেলা বিএনপি’র পদ স্থগিত নেতা রফিকুল ইসলাম শাহপরান, সেলিম জমিদারসহ চিহ্নিত পাথরখেকোদের আসামি করা হয়। একইসঙ্গে দলীয়ভাবে বিএনপি’র তরফ থেকেও পাথরখেকোদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবু জাফলংয়ে পাথরখেকোরা পিছু হটেনি; বরং জাফলং কোয়ারিতে দ্বিগুণ গতিতে লুটপাট চালাতে থাকে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, গত ৫ মাসে জাফলং কোয়ারি থেকে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার বালু ও পাথর লুট করা হয়েছে। এখন তার কোয়ারির উপরের অংশে বালু ও পাথর নেই। এ কারণে পাথরখেকো চক্রের সদস্যরা কোয়ারিতে যন্ত্রদানব ফোর সিলিন্ডার বোমা মেশিন ও এক্সেভেটর নিয়ে লুটপাট চালাচ্ছে। এই লুটপাটে জাফলংয়ের তীরবর্তী খাসিয়া জুমপাড় হুমকির মুখে পড়েছে। এখন জুমের ভেতরের অংশে পাথর লুটপাট চালানো হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তারা। এক্সেভেটরের তিনদিনের তাণ্ডবে দুলালের দোকান, ছাদ মেম্বারের বাঁধ ও খলিলের ঘরের নিকটবর্তী স্থানে ৪-৫টি বিশাল আকৃতির পুকুর খনন করা হয়েছে। পাথর লুটপাট করতে ওই এলাকা এখন পুকুরে পরিণত হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
সর্বশেষ গত বুধবার যখন গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন অভিযান শুরু করে তখন ওই এক্সেভেটরগুলো লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। তবে গত দুদিন ধরে রাতের আঁধারে ফোর সিলিন্ডার বোমা মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে।

রাজু ড্রাইভারের বাড়ির সামনে নয়াবস্তির হেলাল, সাবু, সুমন, আবুল ও শিবুলের নেতৃৃত্বে ৭-৮টি বোমা মেশিন ব্যবহার করা হয়। দু’রাতেই প্রায় কোটি টাকার পাথর লুট করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জুমপাড়সহ আশপাশ এলাকার মানুষ। বোমা মেশিন রাত ১২টা থেকে ৫টা পর্যন্ত চালানো হয়। এ কারণে বোমার শব্দে নয়াবস্তি, কান্দুবস্তির মানুষের ঘুম হারাম হয়ে গেছে। জাফলং নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা প্রশাসনের।এখনো পুলিশ ও বিজিবি পুরোপরি সক্রিয় হতে পারেনি। গোয়াইনঘাট পুলিশের যারা জাফলংয়ে রয়েছেন তারাও সবকিছু না দেখার ভান করেন। পাথরখেকো চক্রের কাছে তারা অসহায় হয়ে পড়েন। প্রায় এক মাস আগে গোয়াইনঘাট উপজেলা প্রশাসন এক অভিযান চালিয়ে লুট করা বিপুল পরিমাণ পাথরসহ ৫০০টি নৌকা আটক করেছিল। পরে স্থানীয়রা সংঘবদ্ধ হয়ে নৌকাসহ ওই পাথরগুলো ছিনিয়ে নেয়।
স্থানীয় একাধিক সুত্র জানিয়েছে, পুলিশ প্রশাসনকে ম্যনেজ করে জাফলংয়ে অবৈধভাবে বালুপাথর উত্তোলন স্বপন-শাহপরান সিন্ডিকেট। যার জন্য পুলিশ ও আনসার সদস্যরা নিয়মিত ডিউটি পালন করলেও তারা কোন বাধা প্রধান করছে না। শুধু পুলিশ-প্রশাসন নয় এ তালিকায় রয়েছেন কিছু সাংবাদিক ও রাজনৈতিক লেবাসধারী পাতিনেতাসহ দরবেশ বাবারা। সুত্র মতে , এই সিন্ডিকেটের প্রধান হলেন বহিস্কৃত বিএনপি নেতা শাহ আলম স্বপন। তার বলয়ে রয়েছেন জেলা বিএনপির সহ-সম্পাদক রফিকুল ইসলাম শাহপরান। তাদের সেল্টার দাতা অপরাধ স¤্ররাজ্যের মুকুটহীন স¤্রাট সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা আব্দুল হাকিম চৌধুরী উরফে দরবেশ বাবা । এই বাহিনীর সদস্যরা সর্বদা দরবেশ বাবার ছত্রছায়ায় থেকে এলাকায় এমন প্রভাব বিস্তার করে। দরবেশ বাবার আস্থাভাজন দুই সেনাপতি স্বপন ও রফিকুল ইসলাম শাহপরান মিলে গোটা জাফলং এলাকা খাবলে খাচ্ছে। তাই অনেকে বলেন তিন খলিফার একই বেশ লুটেপুটে জাফলং শেষ।

পরিবেশ অধিদপ্তর সিলেটের কর্মকর্তারা হামলার ভয়ে জাফলংয়ে অভিযান চালাতে যান না। প্রথম দিকে কয়েকটি অভিযান চালালে তারাও নীরব রয়েছে। ফলে বাধা ছাড়াই জাফলং থেকে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার বালু ও পাথর লুট করা হয়েছে।
সিলেট পর্যটন প্যাকেজ
গোয়াইনঘাট উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইদুল ইসলাম জানিয়েছেন, তার পক্ষ থেকে বুধবার কোয়ারিতে অভিযান চালানো হয়। এখন যেদিকে পাথর নিয়ে আসা হয় সেই স্থানে স্থায়ী ব্যারিকেড দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল। গতকাল প্রশাসনের নিয়োজিত ঠিকাদাররা ব্যারিকেড নির্মাণ করতে গেলে তাদেরকে হুমকি-ধমকি দিয়ে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রশাসনের সব অংশ একসঙ্গে কাজ না করলে লুট ঠেকানো সম্ভব নয়। এখন দিনের বেলা অভিযানের ভয়ে সবাই নীরব থাকে। আর রাতের বেলা তারা লুটপাট চালায়। এ নিয়ে কী করা যায় সেটি নিয়ে তারা চিন্তা-ভাবনা করছেন বলে জানান।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।