মোহাম্মদ কামরুজ্জামান : ফুলতলীর ইসালে সাওয়াব মাহফিল। সম্মেলনের সূচি যেন তাসবীহ, তাহলীলের সুবিন্যস্ত ফর্দ। যিকর, দুরূদ সালাত ও সালামে সজ্জিত। দোয়া ও ইসতিগফারের নূরানী আবেশ সাজানো। ক্ষণে ক্ষণে পবিত্র কুরআনের সুললিত তিলাওয়াত। হামদ ও না’তের সুরে বিমুগ্ধ পরিবেশ। যেখানে মানুষ আসে ভগ্ন হৃদয় নিয়ে। এখানে এসে হারিয়ে যায় মানবতার মহাকালীন স্রোতে। আর্তমানবতার মহাসেবকের কথা শুনে চিরকালীন মানবতার খাদিম হয়ে ওঠে। তা’লীম ও তরবিয়ত পেয়ে পরিশুদ্ধ জীবনের সূচনা করে। যারা ভাবে ফিতরাতের ভাঙা ভুবন থেকে আর ফেরা হবে না। তারা শাশ্বত জীবনের সত্যে পৌঁছে যায়। আখলাক, সদ্ব্যবহার ও সৎকর্মের নব সোপানে পা রাখে। প্রবেশ করে ইসলাহী জীবনের দরজায়। রচনা করে সোনালি জীবনের রূপরেখা। বালাই হাওর মাঠে সিলেটের জকিগঞ্জে প্রতি বছর ১৫ জানুয়ারি ঘটা করে পালিত হয়। মরহুম পীর ছাহেব আল্লামা আব্দুল লতিফ চৌধুরী ফুলতলী (রহ.) এর ইন্তিকাল বার্ষিকী উপলক্ষ। গতানুগতিক কোনো ওরসের জলসা নয়, সুনিপুণ ইসলাহী মাহফিল। ভোর হতেই দূর দূরান্ত থেকে জড়ো হতে থাকে লাখো মানুষ। দুর্দশাগ্রস্ত অসহায় কত মানুষ এখানে উপস্থিত হয়। প্রথাগত অভিজাত জীবনের অপ্রাপ্তির কথা ভুলে যায়। ধুলোমাটির ওপর জায়নামাজ বিছিয়ে বসে পড়ে সামিয়ানার ছায়ায়। সারা জীবনের প্রতিবিম্বিত রূপকে খুঁজে বেড়ায়। নতুন সৃষ্টির ভেতর দিয়ে নিজেকে সাজায়। অনুশোচনা করে অতীত জীবনের ভ্রান্তির। তাওবাহ ও বাইয়াত করে শপথ নেয় পুণ্যকর্মের।
সকাল ১০টায় মরহুম পীর ছাহেবের মাযার যিয়ারত। শুরু হয় খতমের ধারাবাহিকতা। হাফিজ ও কারী সাহেবগণ করেন মহান আল্লাহর পবিত্র কিতাব কুরআন মাজীদের খতম। আলেম ও মুহাদ্দিসগণ করেন রাসূল পাক হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর হাদীসগ্রন্থ সহীহ বুখারী শরীফের খতম। ইযাজতপ্রাপ্ত মুরীদিন করেন দুরূদ শরীফের ওযীফা দালাইলুল খাইরাতের খতম। দূর-দেশের মুহিব্বীনগণ হাজারো খতমের খবর পাঠিয়ে দোয়া প্রার্থনা করেন। সকলে সম্মিলিতভাবে পড়েন খতমে খাযেগান। ইসমে আজমের খতম। আসমাউল হুসনা সমস্বরে পাঠ করে মহান আল্লাহ পাকের অনুগ্রহ প্রার্থনা করা হয়। দরবারে রিসালাতে পৌঁছানো হয় সালাত ও সালাম। বিশ্ববাসীর মুক্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় করা হয় সম্মিলিত মুনাজাত। তারপর চলে যথারীতি ওয়াজ ও নসিহত। মুরশিদের সাহচর্যপ্রাপ্ত আলেমগণ করেন স্মৃতিচারণ। বর্ণনা করেন পীর ছাহেবের খেদমতে খালক ও পুণ্যকর্মের নানাদিক। তাঁর সংগ্রামী জীবনের বিবরণ সঠিক পথে চলার প্রেরণা যোগায়। সময় গড়িয়ে জোহরের আযান হয়। সুবিশাল সামিয়ানায় পবিত্র জোহরের জামায়াতে শামিল হন সবাই। জামায়াত হয় মসজিদ ও খানকাহ ঘরে। নামাজ শেষে স্টেজে আসন গ্রহণ করেন মাহফিলের মধ্যমণি। মরহুম পীর ছাহেবের বড় পুত্র আল্লামা ইমাদ উদ্দিন চৌধুরী। তিনিই ফুলতলীর বড় ছাব। পবিত্র কুরআন থেকে তিলাওয়াত করেন। একটি সূরা মশক করান। আবারো খতমে খাযেগান পড়েন। করেন নসিহত। যেখানে ইহ ও পরকালীন জীবনের সকল সমস্যার সমাধান বাতলিয়ে দেন। কথা বলেন মানুষের ঈমান, আখলাক ও আমল নিয়ে। সুন্দর জীবন পরিচালানার পরামর্শ দেন। কথা বলেন সমাজ ও রাষ্ট্র নিয়ে। নরম স্বরে তিনি রাজাধিরাজের উদ্দেশ্যে তার বিবৃতি পৌঁছে দেন। হুশিয়ারি করেন সরকারের কোনো অশুভ পদক্ষেপের। এতেই নির্ধারিত হয়ে যায় জাতির রাজনীতিক কর্তব্য। ফুলতলী সিলসিলার সামাজিক আন্দোলনের ভিত্তি রচিত তাঁর কথার ইশারায়। তা’লীম ও তরবিয়ত শেষে বিদায় নেন। আবারো শুরু হয় আলেম ও মুবাল্লিগদের বক্তৃতা। যথারীতি আসরের জামায়াত হয়। বাদ আসর দেশ-বিদেশের দূর-দূরান্ত থেকে আগত বিভিন্ন দরবারের পীর ছাহেবগণ বয়ান পেশ করেন। দেশের খ্যাতনামা মাদরাসার অধ্যক্ষ, শায়খুল হাদীস ও আলেমগণ বক্তব্য দেন। অধ্যাপক, বিচারপতি, বুদ্ধিজীবীগণ নিজেদের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে দোয়া কামনা করেন। যিয়ারত চলে রাতদিন। মেহমানদের জন্যে থাকে কয়েক স্তরের মেজবানীর ব্যবস্থা।
বালাই হাওরের মাগরিবের জামায়াত। বিশাল জনসমুদ্র। যেদিকে চোখ যায় শুধু মানুষ আর মানুষ। প্যান্ডেল পেরিয়ে হাওর। বিস্তীর্ণ মাঠ ছাড়িয়ে নামাজের কাতার হয় সড়কে, বাজারের গলিতে। ছাহেব বাড়ি, মাদরাসা আঙিনা, বাজার ও পুকুরপাড়। সবখানে নামাজে দাঁড়িয়ে আছেন মুসল্লী। লক্ষ্য একটাই। নামাজ শেষ তা’লীম-তরবিয়ত, তাওবাহ ও বাইয়াতে শরীক হবেন। মাগরিবের নামাজ সেরে ছয় রাকাআত আওয়াবীনের নামাজ পড়া হয়। বিশ্বজোড়া তরুণ কোনো কারী তেলাওয়াত করেন সূরা ওয়াকিয়া। ঠোঁট নেড়ে সকলে পড়ার চেষ্টা করেন। তারপর একটি হামদ বা না’ত পরিবেশিত হয়। ততক্ষণে সকলের দৃষ্টি চলে যায় মাহফিলের স্টেজের উত্তর দিকে। মাহফিলে আসছেন বড় ছাহেব। লক্ষাধিক মানুষের জমায়েত মুহূর্তে নিরবতায় ছেয়ে যায়। বড় ছাব তিলাওয়াত ও খতমে খাযেগান পড়ে শুরু করেন যিকর। পাঁচ তরীকার যিকর। সুলতানুল হিন্দ হযরত মঈনুদ্দীন চিশতী (রহ.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত চিশতিয়া তরীকা, বড়পীর হযরত আব্দুল কাদির জিলানী (রহ.) এর তরীকায়ে কাদরিয়া, মুজাদ্দিদে আলফে সানী আহমদ ফারুকী সিরহিন্দি (রহ.) এর মুজাদ্দদিয়া তরীকা, বালাকোটের শহীদ হযরত সাইয়্যিদ আহমদ বেরলভী (রহ.) এর মুহাম্মদিয়া তরীকা, সাইয়্যিদ হযরত বাহাউদ্দীন নকশবন্দী বুখারী (রহ.) এর নকশবন্দিয়া তরীকা। এই পাঁচ তরীকার যিকর পদ্ধতি তা’লীম দেন। শিখিয়ে দেন রূহ, নফস ও কলবের যিকর। পাস ও আনপাস তথা শ্বাস-প্রশ্বাসের যিকর পদ্ধতি শেখান। মুখ ও জিহ্বা বন্ধ রেখে নিঃশ্বাস গ্রহণের সময় ‘লা ইলাহা’, শ্বাস ত্যাগের সময় বলা হয় ‘ইল্লাল্লাহ’। আল্লাহু, আল্লাহ যিকর। প্রতি যিকরের শেষে পড়া হয়- লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূল্লাহ (সা.)।
কাব্যিক ভাষায় ফরিয়াদ করেন মহান রবের কাছে। দরদভরা কণ্ঠে বলেন- আয় রাব্বে কারীম, জীবনের বহু পথ পাড়ি দিয়েছি। তোমার কাছে যাবার কোনো সামানা নাই। দয়াময়, আমাদের পার করো। বালাই হাওরজুড়ে পড়ে কান্নার রোল। পাপ, পঙ্কিলতা আর অহমিকায় ভরা কঠিন হৃদয় মোমের মতো গলে পড়ে। সবাইকে নিয়ে ইস্তিগফার পড়েন। অন্ধকার হৃদয়ে আলো জ্বালিয়ে দেন। ঈমানের আলো, মানুষের প্রতি ভালোবাসার আলো। সবুজ পাগড়িতে হাত রেখে তাওবাহ পাঠ করেন। যেন মুরশিদের হাতে হাতে রেখে সকলে শপথ নিচ্ছেন। পরস্পরকে সাক্ষী রেখে তাওবাহ করেন। ছোট-বড়, প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য সকল গুনাহের তাওবাহ করেন। আবারো হয় সম্মিলিত মকবুল মুনাজাত। তাওবাহ ও বাইয়াত শেষে সিলসিলার বুযুর্গানের অমূল্য নসিহত স্মরণ করিয়ে দেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে জীবন শান্তিময় হবে। বড়দের শ্রদ্ধা আর ছোটদের দয়া করো। বয়স ও সহায়ত্বে যারা ছোট সকলের প্রতি দয়া করো। অন্য ভাইয়ের উন্নতি দেখলে মন খুশি রেখো, আল্লাহ পাক তোমার দুনিয়া উজালা করে দিবেন। ক্ষতি করার চেষ্টা করলে দুনিয়া বরবাদ হয়ে যাবে। আবারো দোয়া, মুনাজাত করে বিদায় নেন। এভাবেই পরিসমাপ্তি হয় মহা কাঙ্ক্ষিত তা’লীম ও তারবিয়তের।
ঈসালে সাওয়াব মাহফিলের কোনো মেহমান আগমনের খবর আগে জানানো হয় না। কোনো বছর তাশরীফ আনেন মদীনা মনুওয়ারার সাইয়্যিদ ছাহেবগণ। আসামের উজানডিহির সাইয়্যিদ ছাহেব নিয়মিত তাশরীফ আনেন। বড় ছাহেবের তরবিয়তের পর মেহমানগণ বয়ান পেশ করেন। কখনওবা বিশ্বজোড়া কারী ও হাফিজে হাদীসগণ উপস্থিত থাকেন। শুধু উপমহাদেশ নয়, এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের হকপন্থি আলেমগণ উপস্থিত হন মাহফিলে। আরব বিশ্বের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও স্কলারগণ বক্তব্য দেন। এশার নামাজের পর সিলসিলার অনুসারীদের রাজনীতিক দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়। আবারো শুরু হয় বয়ান। রাতব্যাপী চলে মাহফিল। শেষ রাতে আল্লাহু-আল্লাহ যিকরের ধ্বনিতে প্রকম্পিত হয় হাওর প্রান্তর। ফজরের নামাজ শেষে তাওবাহ ও পবিত্রতার ছাপ নিয়ে বাড়ি ফেরেন সবাই। নেই কোনো কৃত্রিমতা, নেই অতিরঞ্জন। যিকর, আযকার ও নসিহত ব্যতিরেকে অপ্রাসঙ্গিক কোনো আলোচনা হয় না। ফুলতলীর ঈসালে সাওয়াব মাহফিল আমার দেখা সুন্দরতম দ্বীনি সমাবেশ। নবীপ্রেমে সমৃদ্ধ সুন্নীয়তের জনসমুদ্র। ঈসালে সাওয়াব মাহফিল যিকর ও দুরূদের ইসালাহী মজলিস। যেখানে সকল পুণ্যকর্মের সাওয়াব রেছানী করা হয় কবরবাসীদের উদ্দেশ্যে। সিলসিলার বুযুর্গানের ত্যাগের শোকরিয়া আদায় করে দরজা বুলন্দির দোয়া করা হয়। বাংলার প্রতিটি মুসলমানের কাছে এ বার্তা পৌঁছে যাক, ফুলতলীর মাহফিলে নেই কোনো বাড়াবাড়ি অতিরঞ্জন। দ্বীন দরদি সকল মুসলিম ভাইয়ের প্রতি দাওয়াত রইলো, একবার হলেও দেখে যান ফুলতলীর মাহফিল। রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ ও নানা ঘরনার আলেম-উলামা যারা একবার ফুলতলীতে এসেছেন সকলেই মুগ্ধ হয়েছেন। এই বাড়ির আতিথেয়তা, শরাফতী ও দরবারের শুদ্ধতা যে কারো মন ছুঁয়ে যায়। ১৫ জানুয়ারিতে আপনিও আসুন, মুগ্ধ হবেন।