পদোন্নতিসহ বিভিন্ন দাবিতে কর্মবিরতি ঘোষণা বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির

সুরমা টাইমস ডেস্কঃ

ক্যাডার কম্পোজিশনের সুরক্ষা, পদোন্নতি, পদসৃজন, স্কেল আপগ্রেডেশন ও আন্তঃক্যাডার বৈষম্য নিরসনসহ বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের বিভিন্ন দাবি আদায়ে কর্মবিরতি কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতি।

 

আগামী ২ অক্টোবর সারাদেশের সরকারি কলেজ, সরকারি মাদরাসাসহ সব দপ্তর ও অধিদপ্তরে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা এ কর্মসূচি পালন করবেন। মঙ্গলবার দুপুরে সিলেট প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে এ ঘোষণা দেন বিসিএস সাধারণ শিক্ষা সমিতির নেতারা। এ সময় তারা জানান, দাবি আদায় না হলে ১০ অক্টোবর থেকে টানা তিনদিন কর্মবিরতি পালন করা হবে।

লিখিত বক্তব্যে সমিতির সিলেট জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক তৌফিক এজদানী চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য শিক্ষা ক্যাডার সৃষ্টি করা হয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও শিক্ষা ক্যাডারকে বিশেষায়িত পেশা হিসেবে গড়ে তোলা হয়নি। বঞ্চনা আর বৈষম্যের মাধ্যমে এ পেশার কার্যক্রমকে সংকুচিত করা হয়েছে।

 

এ পেশাকে গ্রাস করছে অদক্ষ, অপেশাদাররা, যা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দর্শনের পরিপন্থী।’

উপজেলা, জেলা, অঞ্চলে শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তর, অধিদপ্তর ও প্রকল্পসমূহ পরিচালনায় শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিয়োগের দাবি জানিয়ে তারা বলেন, ‘বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) কম্পোজিশন এন্ড ক্যাডার রোলস ১৯৮০ অনুযায়ী দেশের প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা স্তরের শিক্ষা প্রদান, পরিচালনা, ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা, গবেষণা ও প্রশাসনিক কার্যক্রম পর্যন্ত শিক্ষা ক্যাডারের কার্যপরিধি ব্যাপৃত।

 

প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা স্তর সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরের নবম গ্রেডের উপরে সব পদ শিক্ষা ক্যাডারের তফসিলভুক্ত। এসব পদে শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা বাদে অন্য কারও পদায়নের সুযোগ নেই।

 

দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষা ক্যাডারের তফসিলভুক্ত পদ থেকে শিক্ষা ক্যাডার বহির্ভুতদের অপসারণের দাবি জনিয়েছি। কিন্তু সেটি করা হয়নি। উপরন্তু আমরা লিখিতভাবে আপত্তি জানানোর পরেও বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের তফসিলভুক্ত প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের ৫১২টি পদ শিক্ষা ক্যাডারের তফসিল বহির্ভুত করে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের নিয়োগবিধি চূড়ান্ত করা হয়েছে।

 

এটি স্পষ্টতই শিক্ষা ক্যাডারের অস্তিত্বের উপর আঘাত।’ তিনি বলেন, ‘শিক্ষা ক্যাডারকে অন্ধকারে রেখে এই বিধি করার এখতিয়ার প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নেই। আমরা শিক্ষা ক্যাডারবিরোধী সব কর্মকাণ্ডের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি এবং অবিলম্বে এ বিধি বাতিলের দাবি করছি।’ শিক্ষা ক্যাডারের ১৬ হাজার কর্মকর্তা বর্তমান সরকারের ভিশন-২০৪১ তথা স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং সে মোতাবেক একযোগে কাজ করে যাচ্ছে কিন্তু প্রাপ্য অধিকার ও সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কোনো কারণ ছাড়াই পদোন্নতি বন্ধ আছে দুই বছর।’

এতে আরও বলা হয়, বর্তশানে শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতিযোগ্য কর্মকর্তার সংখ্যা ৭ হাজারের বেশি। এর মধ্যে অধ্যাপক পদে পদোন্নতি যোগ্য ১২০০ জন। সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি যোগ্য ৩০০০ জন, সহকারী অধ্যাপক পদে পদোন্নতি যোগ্য কর্মকর্তা আছেন প্রায় ৩০০০ জন।

 

এই কর্মকর্তাদের পদোন্নতির জন্য সরকারের কোনো অতিরিক্ত অর্থ প্রয়োজন নেই। সবাই পদোন্নতিযোগ্য পদের বেতন স্কেলের সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছে গেছেন। ক্যাডার সার্ভিসে শূণ্য পদ না থাকলে পদোন্নতি দেওয়া যাবে না এমন কোনো বিধান নেই। অথচ, শিক্ষা ক্যাডারকে শূণ্য পদের অজুহাতে দিনের পর দিন পদোন্নতি বঞ্চিত রাখা হয়।

অন্য ক্যাডারের মতো শিক্ষা ক্যাডারে ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি অনুসৃত না হওয়ায় অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তাগণ পিছিয়ে আছেন বলে জানান তারা। বেতন স্কেল অনুযায়ী ৪র্থ ও ৬ষ্ঠ গ্রেড প্রাপ্য কর্মকর্তাদের প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে এক বছর আগে প্রেরণ করা হলেও কোনো অগ্রগতি নেই।

 

বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষক ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট দপ্তরসমূহে জনবলের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগের তুলনায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বেড়েছে, শিক্ষার্থীর সংখ্যাও বেড়েছে, সিলেবাস/কোর্স বেড়েছে কয়েকগুণ।

 

কিন্তু সে তুলনায় পদ সৃজন হয়নি।’ বর্তমান শিক্ষা ক্যাডার নিয়ন্ত্রিত সরকারি কলেজসমূহে উচ্চমাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা স্তরে প্রায় ৫০ লাখ শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষকের পদ সৃজন অপরিহার্য। অথচ বর্তমান সরকারি কলেজসহ শিক্ষা প্রশাসনে কর্মরত শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তার সংখ্যা মাত্র ১৬ হাজার। শিক্ষার মতো এত গুরুত্বপূর্ণ একটি খাতে ১২ হাজার ৪৪৪টি পদ সৃজনের প্রস্তাব আটকে আছে দীর্ঘ ৯ বছর।

 

শিক্ষা ক্যাডারের মতো গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরে ৪র্থ গ্রেডের উপর কোনো পদ নেই জানিয়ে তারা বলেন, ‘অন্য ক্যাডার কর্মকর্তারা পঞ্চম গ্রেড থেকে তৃতীয় গ্রেডে পদোন্নতি পান। কিন্তু শিক্ষা ক্যাডারে সর্বোচ্চ পদ অধ্যাপক পদটি চতুর্থ গ্রেড হওয়ায় শিক্ষা ক্যাডারের পঞ্চম গ্রেড থেকে তৃতীয় গ্রেডে পদোন্নতির সুযোগ নেই। চতুর্থ গ্রেডেই আটকে থাকছেন। অধ্যাপক পদটি তৃতীয় গ্রেডে উন্নীত করা এবং আনুপাতিক হারে ১ম ও ২য় গ্রেডের পদ সৃষ্টি করা জরুরি হয়ে পড়েছে।’

২০১৫ সালে নতুন পে স্কেলে শিক্ষা ক্যাডার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জানিয়ে বক্তারা বলেন, ‘জাতীয় বেতন স্কেল ২০১৫ তে অধ্যাপকদের ৩য় গ্রেডে (সিলেকশন গ্রেড) উন্নীত হওয়ার সুযোগ রহিত হয়ে ৪র্থ গ্রেডে অবনমন ঘটে। বিষয়টি সে সময় প্রধানমন্ত্রীর নজরে আনা হলে তিনি তৎকালীন অর্থমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি কমিটি ও মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে আরেকটি কমিটি গঠন করে দ্রুত নতুন পে-স্কেলের মাধ্যমে সমস্যাসমূহ সমাধানের নির্দেশ দেন।

 

এ কমিটিসমূহের সুপারিশে শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যাপক পদমর্যাদাসম্পন্ন পদসমূহের মধ্যে ৪২৯টি পদ তৃতীয় গ্রেডে উন্নীত করার প্রক্রিয়া শুরু হয়। কিন্তু সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কারণে মাত্র ৯৮টি পদ ৩য় গ্রেডে উন্নীত করতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সম্মতি দেয়। এক্ষেত্রেও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা কার্যকর করা হয়নি।’

‘শিক্ষা ক্যাডারকে অবকাশকালীন বিভাগ করে রাখায় শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তারা পূর্ণ গড় বেতনে অর্জিত ছুটি থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। গ্রীষ্ম ও শীতকালীন অবকাশ চলাকালীন শিক্ষার্থীরা ছুটি ভোগ করলেও শিক্ষকগণ বিভিন্ন জাতীয় দিবস পালন, উচ্চ মাধ্যমিক, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পরীক্ষাসমূহ, ভর্তি, রেজিস্ট্রেশন, ফরম ফিল-আপ এসব কারণে কর্মস্থলে উপস্থিত থাকেন। ফলে শিক্ষার্থীদের ছুটিকালীন শিক্ষকগণ কর্মরত থেকেও অবসর গ্রহণকালে ১০-১৫ লাখ টাকা ক্ষতির সম্মুখিন হচ্ছেন।’ অবিলম্বে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকালকে নন-ভেকেশন সার্ভিস ঘোষণা করে পূর্ণ গড় বেতনে অর্জিত ছুটি প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানায় শিক্ষা ক্যাডার সমিতি।

 

উপজেলায় ও জেলায় মাধ্যমিক শিক্ষা অফিস থাকলেও উচ্চ শিক্ষা দেখভালের জন্য কোনো কর্তৃপক্ষ নেই জানিয়ে সমিতির নেতারা দেশের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়নে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের অধীনে শিক্ষা ক্যাডার নিয়ন্ত্রিত জেলা ও উপজেলা শিক্ষা প্রশাসন প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।

সংবাদ সম্মেলনে মুরারিচাঁদ কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর আবুল আনাম, সিলেট সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর নাজনীন ইসলাম চৌধুরী, সিলেট সরকারি কলেজের সহযোগী অধ্যাপক বিলকিস ইয়াছমীন, শাহপরাণ সরকারি কলেজের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ, সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজ, সিলেটের সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শামীম খান, জকিগঞ্জ সরকারি কলেজের প্রভাষক মো. আতিকুর রহমান, সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসার সহকারী অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনসহ অর্ধশতাধিক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।