Surma Times | Sylhet News

সিলেটের প্রথম অনলাইন সংবাদ পোর্টাল

গোলাপগঞ্জ থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী আব্দুল মতিন আটক

সুরমা টাইমস ডেস্কঃ

 

একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত এবং দীর্ঘদিন যাবৎ পলাতক মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়া যুদ্ধাপরাধী মোঃ আব্দুল মতিন (৭০)’কে সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ এলাকা থেকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব-৩।

 

র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) প্রতিষ্ঠালগ্ন হতে মাদক, অস্ত্র, জঙ্গিসহ বিভিন্ন ধরণের অপরাধ নির্মূলের লক্ষ্যে অত্যন্ত আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে কাজ করে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে রাজধানীর শাহজাহানপুরে টিপু হত্যা, বহুল আলোচিত বিশ^জিৎ হত্যা, পলাতক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত বাউল মডেলসহ বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর ও ক্লুলেস হত্যাকান্ডের রহস্য উন্মোচন ও বিভিন্ন মামলায় দীর্ঘদিনের পলাতক আসামিদের প্রতিনিয়ত আইনের আওতায় নিয়ে আসার মাধ্যমে সর্বস্তরের জনগণের প্রশংসা ও আস্থা অর্জন করেছে।

 

এছাড়াও বিগত ০৬ মাসে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীসহ বিভিন্ন মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত, যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের বিরুদ্ধে ১৮৫টি অভিযান পরিচালনা করে ০৪ জন একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিসহ সর্বমোট ১৮৬ জন আসামি গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

 

এরই ধারাবাহিকতায় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গত রাতে র‌্যাব-৩ এর একটি আভিযানিক দল সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ হতে একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত এবং দীর্ঘদিন যাবৎ পলাতক মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নিয়ে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়া যুদ্ধাপরাধী মোঃ আব্দুল মতিন (৭০), পিতা-মৃত মিরজান আলী, সাং-পাখিয়ালা, থানা-বড়লেখা, জেলা-মৌলভীবাজার’কে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

 

ধৃত আসামির বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ ও ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ০৫ টি অভিযোগ আনা হয়। ধৃত আসামি আব্দুল মতিন এবং উক্ত মামলার অপর আসামি তারই আপন ভাই আব্দুল আজিজ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতের বারপুঞ্জিতে মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে তারা পালিয়ে বড়লেখায় এসে রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেন।

 

ধৃত আব্দুল মতিন বড়লেখা থানা জামায়াত ইসলামী এবং ১৯৭১ সালে গঠিত ইসলামী ছাত্র সংঘ এর সক্রিয় সদস্য ছিল। আব্দুল মতিনসহ রাজাকার বাহিনীর অন্যান্য সদস্যরা মিলে মৌলভীবাজার এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, অপহরণ, নির্যাতন, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণসহ মানবতাবিরোধী কর্মকান্ড চালাত।

১৯/০৫/১৯৭১ তারিখে ধৃত আব্দুল মতিনসহ এই মামলার অপর দুই আসামি আব্দুল আজিজ, আব্দুল মান্নান এবং তাদের সহযোগীরা মিলে মৌলভীবাজারের বড়লেখা থানাধীন ঘোলসা গ্রাম থেকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা হরেন্দ্রলাল দাস @ হরিদাস, মতিলাল দাস, নগেন্দ্র কুমার দাস এবং শ্রীনিবাস দাসকে অপহরণ করে। তাদেরকে ০৩ দিন যাবৎ বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে আটক রেখে অমানবিক নির্যাতন করার পরে জুড়ি বাজার বধ্যভূমিতে নিয়ে যায়। সেই বধ্যভ‚মিতে হরেন্দ্রলাল দাস @ হরিদাস, মতিলাল দাস এবং নগেন্দ্র কুমার দাস এই ০৩ জনকে হত্যা করা হয়। অপহরণকৃত শ্রীনিবাস দাস নির্যাতিত অবস্থায় কোনক্রমে পালিয়ে কয়েকদিন পর বাড়ি ফিরে যায়।

 

১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে ধৃত মতিন, মামলার অপর আসামি আব্দুল আজিজ ও আব্দুল মান্নান এর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা বড়লেখা থানাধীন কেছরিগুল গ্রামের বাসিন্দা সাফিয়া খাতুন এবং আব্দুল খালেককে অপহরণ করে কেরামত নগর টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়।

 

উক্ত রাজাকার ক্যাম্পে আসামিরা সাফিয়া খাতুনকে পালাক্রমে গণধর্ষণ করে। পরবর্তীতে তারা টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্প হতে সাফিয়া খাতুনকে প্রথমে শাহবাজপুর রাজাকার ক্যাম্প এবং কিছুদিন পর বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানেও সাফিয়া খাতুনকে বারবার গণধর্ষণ করা হয়। ০৬/১২/১৯৭১ তারিখে বড়লেখা হানাদারমুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা সাফিয়া খাতুনকে সিও অফিসের বাংকার থেকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে।

 

১৩/১১/১৯৭১ তারিখ ধৃত মতিনসহ রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা মিলে বড়লেখা থানার পাখিয়ালা গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মঈন কমান্ডারের বসতবাড়িতে সশস্ত্র হামলা করে ব্যাপক লুটপাট চালায়। মুক্তিযোদ্ধা মঈনের পিতা বছির উদ্দিন, চাচা নেছার আলী, ভাই আইয়ুব আলী ও ভাতিজা হারিছ আলীকে অপহরণ করে বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়।

 

সেখানে তাদেরকে কিছুদিন আটক রেখে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো হয়। পরবর্তীতে ০৬/১২/১৯৭১ তারিখ বড়লেখা হানাদারমুক্ত হলে মুক্তিযোদ্ধারা তাদেরকে রাজাকার ক্যাম্প হতে উদ্ধার করেন।

 

১৪/১১/১৯৭১ তারিখ ধৃত মতিন, মামলার অপর আসামি আব্দুল আজিজ ও আব্দুল মান্নান এর নেতৃত্বে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা বড়লেখা থানাধীন হিনাই নগর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধা মুস্তাকিন কমান্ডারের বাড়িতে সশস্ত্র হামলা করে। মুক্তিযোদ্ধা মুস্তাকিন’কে তারা বাড়িতে না পেয়ে মুস্তাকিনের ভাই মতছিন আলীকে অপহরণ করে বড়লেখা সিও অফিস রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতন করে। তাদের অমানবিক নির্যাতনের ফলে মতছিন আলীর পা ভেঙে যাওয়াসহ গুরুতর আহত হয়। পরবর্তীতে রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা মুস্তাকিন ও মতছিন আলীর বসতবাড়িতে লুটতরাজ চালায় এবং অগ্নিসংযোগ করে কয়েকটি টিনের ঘর পুড়িয়ে দেয়।

 

১৭/১১/১৯৭১ তারিখ ধৃত আসামি মতিন এবং অন্যান্যরা মিলে বড়লেখা থানাধীন ডিমাই বাজার থেকে মুক্তিযোদ্ধা মনির আলীকে আটক করে। তাকে সাথে করে নিয়ে তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা হাবিব কমান্ডারকে আটক করার জন্য তাদের বাড়িতে হামলা চালায়।

 

সেখান থেকে তারা মনির আলী ও তার স্ত্রী আফিয়া বেগমকে অপহরণ করে কেরামত নগর টি-গার্ডেন রাজাকার ক্যাম্পে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়ার পরে তারা মনির আলীর স্ত্রী আফিয়া বেগমকে পালাক্রমে গণধর্ষণ করে। বসতবাড়িতে হামলা চালানোর সময় হাবিব কমান্ডার ও মনির আলীর ঘরের যাবতীয় মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায় রাজাকার বাহিনীর সদস্যরা।

 

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের তদন্ত সংস্থা ২০১৪ সালের ১৬ অক্টোবর ধৃত আব্দুল মতিন, আব্দুল মান্নান @ মনাই এবং আব্দুল আজিজ @ হাবুলের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে। উক্ত তদন্তটি ১৪/১১/২০১৬ তারিখে শেষ হয় এবং তদন্ত চলাকালীন ২৯/০২/২০১৬ তারিখ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এর প্রেক্ষিতে ০১/০৩/২০১৬ তারিখ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী আব্দুল আজিজ @ হাবুল ও আব্দুল মান্নান @ মনাই’কে গ্রেফতার করে এবং তারা বর্তমানে কাশিমপুর কারাগারে আটক রয়েছে। অপরদিকে ধৃত আসামি আব্দুল মতিন তখন গ্রেফতার এড়াতে আত্মগোপনে চলে যায়।

পরবর্তীতে গভীর তদন্তে আসামীদের বিরুদ্ধে আনীত ০৫ টি অভিযোগ প্রসিকিউশনের মাধ্যমে প্রমানিত হলে ১৯/০৫/২০২২ তারিখ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল কর্তৃক আব্দুল মতিন, আব্দুল আজিজ এবং আব্দুল মান্নান’কে মৃত্যুদন্ড প্রদান করা হয়।

 

ধৃত আব্দুল মতিনের বিরুদ্ধে ২০১৬ সালে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারী হওয়ার পরপরই আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেফতার এড়াতে সে পলাতক জীবন যাপন শুরু করে। সে মৌলভীবাজারের বড়লেখা থানাধীন পাখিয়ালা গ্রামের নিজ বাড়ি ছেড়ে সিলেট জেলার গোলাপগঞ্জ থানা এলাকায় তার ভাগ্নের বাড়িতে আত্মগোপন করে।

সেখানে সে নিজেকে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিত। মুক্তিযুদ্ধের সময় হতে শুরু করে পলাতক জীবন শুরু করার পূর্ব পর্যন্ত ধৃত মতিন জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। তার ভাগ্নের বাড়িতে দীর্ঘ ০৭ বছর যাবৎ পলাতক থাকাকালীন গতরাতে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-৩ কর্তৃক গ্রেফতার হয় এই অপরাধী। গ্রেফতারকৃত আসামির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।