সেনাবাহিনীর শ্বাসরুদ্ধকর অভিযান নিয়ে যা জানা গেল

সুরমা টাইমস ডেস্ক :

ঢাকার অপরাধজগতের ত্রাস, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনকে গ্রেফতার করেছে সেনাবাহিনী। গত মঙ্গলবার সকালে কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকায় তিন ঘণ্টার এক শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানে সহযোগীসহ তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। সরকারের একটি দায়িত্বশীল সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।

গত মঙ্গলবার ভোরে কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা মসজিদ সড়কের মীর মহির উদ্দিনের বাড়ির তিনতলা থেকে তাদের গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে পাঁচটি বিদেশি পিস্তল, ১০টি ম্যাগাজিন, ৫৩ রাউন্ড গুলি ও একটি স্যাটেলাইট ফোন উদ্ধার করা হয়েছে। পরে তাদের ঢাকায় নিয়ে আসে সেনাবাহিনী।

গ্রেফতারকৃত সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রাজধানীর হাতিরঝিল থেকে দুই সহযোগী শ্যুটার আরাফাত ও শরীফকেও গ্রেপ্তার করেছে সোনবাহিনী।

 

দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা তৎপরতার পর গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয় ও সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সেনাবাহিনী।

মঙ্গলবার বিকেল ৫টায় ঢাকা সেনানিবাসে সংবাদ সম্মেলনে আইএসপিআরের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, মঙ্গলবার ভোর ৫টা থেকে শুরু হওয়া কুষ্টিয়া ও হাতিরঝিলে পরিচালিত সাঁড়াশি অভিযানে ৪৬ স্বতন্ত্র ইনফ্রেন্ট্রি ব্রিগেডের একটি ইউনিট সফলভাবে দুজন শীর্ষ সন্ত্রাসী ও তাদের দুই সহযোগীকে গ্রেফতার করতে সক্ষম হয়।

গ্রেফতারকৃতরা হলো- দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন ওরফে ফতেহ আলী ও আবু রাসেল মাসুদ ওরফে মোল্লা মাসুদ এবং দুইজন শ্যুটার আরাফাত ও শরীফ। লেফটেন্যান্ট কর্নেল সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী বলেন, এই চক্রটি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে হত্যা, চাঁদাবাজি ও নাশকতা চালিয়ে আসছিল। সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ হলেন তালিকাভুক্ত ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসী দলের অন্যতম নেতা এবং সেভেন স্টার চক্রের মূল পরিকল্পনাকারী।

 

এই অভিযান ছিল দীর্ঘদিনের গোয়েন্দা তৎপরতা ও পরিকল্পনার ফসল। অপারেশনটি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ক্ষয়ক্ষতি বা সংঘর্ষ ছাড়াই পরিচালিত হয়, যা আমাদের বাহিনীর পেশাদারত্ব এবং রাষ্ট্রের প্রতি দায়বদ্ধতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

 

অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয় ও সহায়তা প্রদান করেছে সেনাসদরের সামরিক অপারেশন পরিদপ্তর, ৫৫ পদাতিক ডিভিশন, ১৪ স্বতন্ত্র ইঞ্জিনিয়ার বিগ্রেড, ৭১ মেকানাইজ বিগ্রেড ও এনএসআই।

 

সামি-উদ-দৌলা চৌধুরী বলেন, দেশের জনগণকে জানাতে চাই, যে কোনো ধরনের সন্দেহজনক কর্মকা- কিংবা সন্ত্রাসবাদ সংক্রান্ত তথ্য অনুগ্রহ করে নিকটস্থ সেনাক্যাম্প অথবা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবহিত করুন। আমরা আবারও দৃঢ়ভাবে জানাতে চাই সেনাবাহিনী প্রধানের সুস্পষ্ট নির্দেশনার আলোকে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা এবং জনগণের জানমালের সুরক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সর্বোচ্চ প্রস্তুত ও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী সব সময় জনগণের পাশে আছে এবং থাকবে।

কুষ্টিয়া শহরের কালিশংকরপুর এলাকার সোনার বাংলা মসজিদ সড়কের মীর মহির উদ্দিনের মালিকাধীন তিনতলা ভবনের নিচতলা থেকে তাদের গ্রেফতার করে ঢাকা থেকে যাওয়া সেনাবাহিনীর একটি আভিযানিক টিম। দেড় মাস আগে ওই বাসাটি ভাড়া নেন তারা। ওপরের দুই তলায় ছাত্রাবাস ছিল।

পেছনের বাসার এক নারীর মাধ্যমে বাসাটি ভাড়া নেওয়া হয়। বাড়ি ভাড়া নেওয়ার পর থেকে নিচতলার দরজা-জানালা তেমন একটা খুলতেন না দুই সন্ত্রাসী। দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী গ্রেফতারের খবরে ভবনটির সামনে ভিড় করে এলাকাবাসী।

কোনো একটা বিষয় নিয়ে কানাঘুষা করছেন তারা। গণমাধ্যমকর্মীদের দেখে স্থান ত্যাগ করেন অনেকে। যারা দাঁড়িয়ে ছিলেন তারাও সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি নন। সুব্রত বাইন ‘সেভেন স্টার’ বাহিনীর প্রধান ছিলেন।

 

পুলিশের খাতায় তার পুরো নাম ত্রিমাতি সুব্রত বাইন। বহুদিন ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ড কাঁপিয়ে ভারতের কারাগারে কিছুদিন বন্দি ছিলেন। সুব্রত বাইনের আদি নিবাস বরিশালের আগৈলঝাড়া থানার জোবারপাড় গ্রামে।

 

তার বাবা বিপুল বাইন ছিলেন একটি এনজিওর গাড়িচালক। মা কুমুলিনি আর তিন বোন মেরি, চেরি ও পরীকে নিয়ে ঢাকার মগবাজারের ভাড়া বাসায় থাকতেন। সুব্রত বাইন বড় সন্তান।

 

১৯৬৭ সালে জন্ম হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে। বরিশালে অক্সফোর্ড মিশন স্কুল নামে খ্রিস্টান মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেন সুব্রত বাইন। সেখানে হোস্টেলে থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।

 

পরবর্তীতে ঢাকায় শেরেবাংলা উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণিতে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে এসএসসি। এরপর সিদ্ধেশ্বরী কলেজে ভর্তি হতে গিয়ে সেখানকার এক নেতার সঙ্গে পরিচয়।

কলেজে ভর্তি হওয়া আর হয়নি সুব্রতর। তখন থেকে খাতা-কলমের বদলে হাতে ওঠে অস্ত্র। সুব্রতর নেতৃত্বে মগবাজারে একটি সন্ত্রাসীচক্র গড়ে ওঠে।

 

১৯৯৩ সালের দিকে মধুবাজার বাজারে সবজি বিক্রেতা খুন হলে পুলিশের তালিকায় তার নাম ওঠে। এর কিছুদিন পর মগবাজারের বিশাল সেন্টার নির্মাণের সময় চাঁদাবাজি নিয়ে গোলাগুলি হয়। এর পর থেকেই সুব্রত বাইনের নাম গণমাধ্যমের শিরোনামে আসে।

পরে বিশাল সেন্টারের দোকান মালিক সমিতির নেতা হন সুব্রত বাইন। ১৯৯১ নির্বাচনে তিনি মগবাজার এলাকায় কাজ করেন। সে সময় যুবলীগের লিয়াকত মগবাজার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করতেন।

 

মগবাজারের মধুবাগ মাঠে তার জন্মদিনের উৎসব হয়। সেই উৎসবে অনেক নেতা হাজির হওয়ার পর থেকে সুব্রত বাইন তারকা সন্ত্রাসী বনে যান। এরপর ১৯৯৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ট্রিপল মার্ডারে নেতৃত্ব দেন সুব্রত। এছাড়া মগবাজারের রফিক, সিদ্ধেশ্বরীর খোকনসহ বেশ কয়েকজন তার হাতে খুন হন।

 

এভাবে খুব অল্প সময়ে রাজধানীর দক্ষিণাংশের একটি বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ সুব্রত বাইনের হাতে চলে আসে। তার বিরুদ্ধে সে সময় কমপক্ষে ৩০টি মামলা হয়।

এর মধ্যে ১৯৯১ সালে আগারগাঁও জাসদ ছাত্রলীগ নেতা মুরাদকে হত্যা করা হয়। এ খুনের ঘটনায় তার যাবজ্জীবন সাজা হয়। ১৯৯৭ সালে নয়াপল্টন এলাকার একটি হাসপাতাল থেকে গোয়েন্দা পুলিশের এসি আকরাম হোসেন গ্রেফতার করেন সুব্রত বাইনকে।

বছর দেড়েক জেলে থাকার পর জামিনে বেরিয়ে যান। ২০০১ সালের ২৫শে ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর নাম এবং তাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করে সরকার।

 

এ তালিকায় প্রথম নাম ছিল সুব্রতর। এরপর সুব্রত ঢাকা ছেড়ে কলকাতায় ঘাঁটি গাড়েন। ভারতে জমি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য যাবতীয় নথিপত্র তৈরি করেন সুব্রত। সুব্রত বাইনের সঙ্গে আলোচনায় আসা আরেক নাম মোল্লা মাসুদ।

মতিঝিল-গোপীবাগের ত্রাস হিসেবে এক সময় পরিচিত এই সন্ত্রাসী বহু বছর ধরে ভারতের মাটিতে আত্মগোপনে ছিলেন।

 

ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এবং বাংলাদেশের র‌্যাব ও ডিবির বরাত অনুযায়ী মাসুদ কলকাতায় বসবাস করতেন ‘আবু রাসেল মো. মাসুদ’ নামে এবং এক ভারতীয় নাগরিক রিজিয়া সুলতানাকে বিয়ে করে দীর্ঘদিন সেখানে অবস্থান করছিলেন।

 

২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ভারতের মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতা পুলিশের অ্যান্টি-টেররিজম স্কোয়াড (এটিএস) তাকে গ্রেফতার করে। ব্যারাকপুর থানা পুলিশ ও কলকাতার সিআইডি যৌথভাবে তাকে দুই দফায় ১৮ দিনের রিমান্ডে নেয়।

 

তাকে গ্রেফতারের বিষয়টি অত্যন্ত গোপনীয়ভাবে বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে ভাগ করে নেয় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।

মোল্লা মাসুদের বিরুদ্ধেও রয়েছে অন্তত ৩০টিরও বেশি মামলা। এর মধ্যে রয়েছে-বিএনপি নেতা কামাল মজুমদারের ভাগনে মামুন হত্যা, পুরান ঢাকার ‘মুরগি মিলন’ হত্যাকান্ড, খিলগাঁওয়ের তিলপাপাড়ায় ট্রিপল মার্ডার এবং রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজির অসংখ্য অভিযোগ।

মাসুদ মূলত ঢাকার বড় ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করত এবং সেই টাকা হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে পৌঁছে যেত।

উল্লেখ্য, শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনকে ধরতে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি রয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।