সুরমা টাইমস ডেস্ক : সিলেটের আলোচিত ক্যাডার পীযূষ কান্তি দে’র ১২ বছরের সাজা হয়েছে। সে বর্তমানে পলাতক রয়েছে। তার বিরুদ্ধে জারি করা হয়েছে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা। দলিল জালিয়াতির ঘটনায় সিলেটের বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালতের বিচারক শাহাদাত হোসেন প্রামাণিক এই রায় দেন।
সূত্র জানিয়েছে, জালিয়াতির ও ভূমিদস্যুতার একটি মামলায় বৃহস্পতিবার দেয়া রায়ে পীযূষ ও তার সহযোগী ৮ জনের প্রত্যেককে ১২ বছর করে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়। এ মামলার বাদী মিহির দেব নামে এক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন ভূমির প্রকৃত মালিক। তার ভূমি জালিয়াতি করে জোরপূর্বক দখল করতে চেয়েছিল পীযূষ। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে পীযূষের সহযোগী প্রণয়, বিনয় ভূষণ, নোমান ও দুলাল দত্তকে রায় ঘোষণার পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আর পীযূষ সহ বাকি ৪ জন পলাতক রয়েছেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ছাত্রলীগের সাবেক ক্যাডার পীযূষ কান্তি দে নগরের মীর্জাজাঙ্গাল এলাকায় আসন গেড়ে বসে। ওখানে সে জমি দখল করে নিজের অপরাধ কর্মের অফিস ও ক্যাডারদের আস্তানা গড়ে তোলে। ফলে জমির মালিকরা তার দাপটের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিলেন।
২০১৯ সালের ২২শে জানুয়ারি ও একই বছরের ১২ই সেপ্টেম্বর র্যাব-৯ পীযূষকে নগরের তালতলা এলাকায় গ্রেপ্তার করেছিল। পরে সে জামিনে বেরিয়ে ফের অপরাধ কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে। ওই সময় তালতলার একটি হোটেল দখলের সময় তাকে অস্ত্র সহ আটক করা হয়। ইয়াবাও উদ্ধার করা হয় তার কাছ থেকে। তবে পীযূষের অপরাধ ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা সোচ্চার ছিলেন। এ কারণে প্রশাসনিক ভাবে পীযূষ কোনো ছাড় পায়নি।
বাদীপক্ষ জানিয়েছেন- আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকার সময় মামলা পরিচালনায় নানা ভয়ভীতি ও হুমকির মুখে পড়তে হয়েছে। বাদীকে হুমকি দেয়া ছাড়াও সাক্ষীদের ভীতি প্রদর্শন করে সাক্ষ্য দেয়া থেকে বিরত রাখে। বার বার বিচারকাজ বাধাগ্রস্ত করতে নানাভাবে সময়ক্ষেপণ করে।
৫ই আগস্টের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর মামলার বিচারকাজ দ্রুত শেষ করে রায় ঘোষণা করেন বিচারক। আদালতের বেঞ্চ সহকারী জামিল আহমদ জানিয়েছেন- ‘পীযূষ সহ ৮ জনের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। এর মধ্যে চারজন কারাগারে ও চারজন পলাতক রয়েছেন। পলাতকদের বিরুদ্ধে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।’ এদিকে পরপর দু’বার গ্রেপ্তার হওয়ার পর পীযূষ পরবর্তীতে তার ওই অপরাধ আস্তানা ছেড়ে দেয়। ওই সময় সে জাল দলিল ও বালাম বইয়ের পাতা টেম্পারিং করে জমির বৈধতা নেয়ার চেষ্টা চালায়। এতে ভূমির মালিকরা নানা ধরনের হেনস্তার শিকার হন। একই সময় সিলেটের সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসেও সে প্রভাব বিস্তার করে। অফিসের কয়েকজন কপিস্টকে হাত করে সে কয়েকটি ভুয়া দলিল সৃজন করে। একই সঙ্গে বালাম বইও পরিবর্তন করে ফেলে। এ নিয়ে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দলিল লেখকদের মধ্যে তোলপাড় হয়।
এদিকে পীযূষের নানা বিতর্কিত ঘটনার পর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নাসির উদ্দিন খান ওই এলাকাতে তার ব্যক্তিগত অফিস করেন। এরপর থেকে পীযূষ মীর্জাজাঙালের ওই এলাকা ছেড়ে মন্দির এলাকায় তার দলবল নিয়ে অবস্থান নেয়।
পীযূষ কান্তি সিলেট ছাত্রলীগের সাবেক দুর্ধর্ষ ক্যাডার। তার বাড়ি নগরীর শেখঘাট ভাঙাটিকর এলাকায়। তিনি বর্তমানে সিলেট জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি। কয়েক বছর আগে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার ভাঙচুরের দিন পীযূষ তার সঙ্গীদের নিয়ে সিলেট নগরে প্রকাশ্যে অস্ত্রের মহড়া দেয়। ওই সময় সে নগরের আলহামরা শপিং সেন্টার ভাঙচুর ও আগুন দেয়। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও পীযূষের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। অস্ত্রসহ বন্দুক হাতে থাকা পীযূষের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হলে তুমুল আলোচনা-সমালোচনা দেখা দেয় সিলেট জুড়ে। এদিকে ৫ই আগস্টের পূর্বে সিলেটের রাজপথে সশস্ত্র অবস্থায় পীযূষ মাঠে ছিল। তার নেতৃত্বে ছিল কয়েকজনের একটি গ্রুপ। ওই গ্রুপের কর্মীদের হাতে কয়েকটি আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। দুর্ধর্ষ সব অস্ত্রবাজ নিয়ে নানা সময় নগরে মহড়া দেয়া হয়।
আহতরা জানিয়েছেন- নগরের কোর্ট পয়েন্ট, জিন্দাবাজার, বারুদখানা, জল্লারপাড় সহ কয়েকটি এলাকায় ছাত্র-জনতার সঙ্গে সংঘর্ষের সময় পীযূষের গ্রুপের সশস্ত্র নেতাকর্মীরা জনতাকে উদ্দেশ্য করে গুলিবর্ষণ করে।
জিন্দাবাজার এলাকার ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন- ৪ঠা আগস্ট সিলেটের রাজপথে যে আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শিত হয়েছে অতীতে কখনোই এত অস্ত্র প্রদর্শিত হয়নি। এসব আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে বহু মানুষ গুলিবিদ্ধ হন। ওই দিন নগরের জিন্দাবাজার থেকে গুলিবিদ্ধ কয়েকজনকে উদ্ধার করে গুরুতর অবস্থায় হাসপাতালে পাঠানো হয়। ৫ই আগস্টের প্রেক্ষাপট পরিবর্তনের পর থেকে পীযূষের আস্তানা ও তার ভাঙাটিকরস্থ বাড়িতে উত্তেজিত জনতা হামলা চালায়। পীযূষের বাড়িতে ভাঙচুর ছাড়াও জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
এরপর থেকে পলাতক রয়েছে পীযূষ। ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলিবর্ষণ, নিহত ও আহত হওয়ার ঘটনায় ১০টিরও বেশি মামলায় আসামি হয়েছে সে। তার খোঁজে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা একাধিক স্থানে অভিযান চালালেও খুঁজে পায়নি।