জমি দখল করে বাগমারার ‘জমিদার’ এনামুল হক
সুরমা টাইমস ডেস্ক : এনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও রাজশাহী ৪ (বাগমারা) আসনের সাবেক এমপি এনামুল হকের বিরুদ্ধে দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অভিযোগ থাকায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাকে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হামলা ও হত্যাচেষ্টাসহ স্থানীয় পর্যায়ের বিভিন্ন প্রকল্পে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগে সম্প্রতি র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন এনা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও রাজশাহী ৪ (বাগমারা) আসনের সাবেক এমপি এনামুল হক। তিনি ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে এমপি নির্বাচিত হন। টানা তিনবার এমপি থাকা এনামুলের বিরুদ্ধে অন্যের জমি দখলসহ অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল সম্পদ গড়ার অভিযোগে ২০১৪ সালেই দর্নিীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রাথমিক তদন্তে হাজার কোটি টাকার তথ্য গোপন ও ঋণখেলাপির তথ্য উঠে আসে। এর বাইরে তিনি গত ১০ বছরে আরও অন্তত ৫০০ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। গত ১৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আদাবর থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এনামুল হককে। স্থানীয়রা জানান, এনামুলের আচরণ ছিল অনেকটা জমিদারদের মতো। নিজের সন্ত্রাসী বাহিনীর পাশাপাশি প্রশাসনকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে দখলে নিতেন অন্যের জমি। পুকুর খনন প্রকল্প, সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিতেন। তাহেরপুর পৌরসভায় যেকোনো বরাদ্দ এলেই তাকে নির্দিষ্ট হারে কমিশন দিতে হতো। বাগমারা উপজেলার বরাদ্দ করা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বাজেট থেকেও ১০ শতাংশ হারে কমিশন নিতেন তিনি। গোয়েন্দা সংস্থা, হলফনামা ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০০৮ সালে এনামুল হক ও তার স্ত্রীর শেয়ারসহ নগদ ও ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা। ১৫ বছরের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে সাড়ে ১৩ কোটি টাকার ওপরে। আর ২০০৮ সালে যেখানে তার বার্ষিক আয় ছিল ২০ লাখ টাকা, ১৫ বছরে তা বেড়ে হয়েছে ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা। এ ছাড়া সংসদ সদস্য হয়ে অনিয়ম করে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমোদন পেয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। আরও জানা যায়, ২০১৪ সালে বাগমারা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য এনামুল হকের বিরুদ্ধে আয়বহির্ভূত অন্তত ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের তথ্য পেয়েছে দুদক।
সূত্রমতে, এনামুল হক এবং তার স্ত্রী তহুরা হক দুদকে মাত্র ৮ কোটি ৩৪ লাখ ৬৫ হাজার ৫০০ টাকার সম্পদ বিবরণী দাখিল করেছিলেন। কিন্তু ওই সময়ই তাদের সম্পদ ছিল অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকার। এনামুলকে ওই সময় দুদক কার্যালয়ে হাজির হওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী এক নেতার প্রভাবে সে সময় তিনি পার পেয়ে যান। তখন দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এনামুল হকের মালিকানাধীন ও অংশীদারত্বে থাকা ১৪টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য গোপন করা হয়। এ ছাড়া এনা প্রপার্টিজ, সালেহা-ইমারত কোল্ড স্টোরেজ, এনা-ডুঙ্গা লিজিং, নর্দান পাওয়ার সলিউশন লিমিটেড, এনা ইন্টারন্যাশনাল, এনা কারস, এনা এনার্জি লিমিটেডসহ অন্য প্রতিষ্ঠানে তার শেয়ার বা মালিকানার বিষয়টিও সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেননি। সূত্র জানায়, ২০০৮-৯ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরের আয়কর রিটার্নেও এনামুল হক সম্পদের তথ্য গোপন করেছিলেন। তার নামে ১৪টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান থাকলেও আয়কর রিটার্নে উল্লেখ করা হয়েছিল সাতটি প্রতিষ্ঠানের নাম। তবে দুদক অনুসন্ধান চালিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন (উত্তর-দক্ষিণ), রাজশাহী সিটি করপোরেশন, ব্র্যাক-ডেল্টা হাউজিং, রাজশাহী জেলা রেজিস্ট্রার, বাগমারা, নওগাঁ, নবাবগঞ্জ, নাটোর সাব-রেজিস্ট্রার, ঢাকার ১৩টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস এবং ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রারসহ ঢাকা ও রাজশাহীর বিভিন্ন ব্যাংক থেকে এনামুল হক এবং তার স্ত্রী তহুরা হকের নামে অর্থ ও স্থাবর সম্পত্তি রেজিস্ট্রেশনসংক্রান্ত তথ্য যাচাই-বাছাই করে বিপুল সম্পদের তথ্য পেয়েছে। শুধু তা-ই নয়, ঢাকার মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে আদালতের জব্দ করা সম্পত্তি দখলের অভিযোগও রয়েছে এনামুল হকের বিরুদ্ধে। জমির মালিক মেট্রো হোমস লিমিটেডের মধ্যে মামলা জটিলতার সুযোগে ওই জমি দখল করেন এনামুল। মেট্রো হোমসের তত্ত্বাবধানে নির্মীয়মাণ একটি বাণিজ্যিক ভবন ও জায়গা আদালত কর্তৃক জব্দ ও স্থিতাবস্থার আদেশ থাকার পরও এনামুল হকের এনা গ্রুপ ওই জায়গায় সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দখল করে নেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে বাগমারা উপজেলার মাড়িয়া ইউনিয়নের গোয়ালপাড়া গ্রামে ২০ বিঘা জমির ওপর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। তৎকালীন এমপি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক ও তার ভাই মাড়িয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রেজাউল হক লেদা প্রকৃত জমির মালিকদের মামলার ভয় দেখিয়ে হামলা চালিয়ে এসব জমি হাতিয়ে নেন। জমির মালিকদের মূল্যও পরিশোধ করা হয়নি। এমনকি জমিতে থাকা ফসল তুলতে গেলেও তাদের ওপর হামলা চালানো হয়। দখল হওয়া প্রায় সাড়ে তিন বিঘা জমির মালিক আশিক আলী প্রামাণিক বলেন, ‘এনামুল যখন জমি দখল করতে শুরু করল, আমরা সবাই মামলা করি। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি। জমির দলিলে দেখানো হয়েছে ডোবা। এখন পর্যন্ত কোনো টাকা দেয়নি। উল্টো বলেছে, আমরা নাকি জমি দান করে দিয়েছি। পুলিশ, ইউএনও, এসিল্যান্ড সবাই তার কথায় উঠত-বসত।’ আশিকের মতো আরও ১৫ জন ভুক্তভোগী এনামুলের অবৈধ দখলের শিকার হয়েছেন। ভবানীগঞ্জ বাজার এলাকার সত্তরোর্ধ্ব সামায়ন আলীর দাবি, তার কোটি টাকা মূল্যের জমিও এনামুল সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে দখলে নিয়েছে। সম্প্রতি সেখানে মার্কেট নির্মাণ করেছেন ভবানীগঞ্জ পৌরসভার সাবেক মেয়র আব্দুল মালেক। এলাকাবাসীর দাবি, তিনবার এমপি থাকায় এনামুল এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলেন। কেউ প্রতিবাদ করলেই হেলমেট বাহিনী দিয়ে হামলা চালানো হতো। সেই সঙ্গে প্রশাসনকে ব্যবহার করে গ্রেপ্তার করা হতো। এভাবে শক্তি প্রয়োগ করে তিনি ভবানীগঞ্জে একটি বহুতল মার্কেট গড়েছেন। ভুক্তভোগী জুলেখা খাতুন বলেন, ‘আমাদের ওখানে দুটি দোকান ছিল। কিন্তু এনামুল নিজের মার্কেট করতে গিয়ে ওই সব দোকান ভেঙে ফেলেছেন। তার মার্কেটের সামনের রাস্তা প্রশস্ত করেছেন। এ ছাড়া ২০১২ সালে এই মার্কেটের অন্তত ৫০ জন ভুক্তভোগীকে উচ্ছেদ করে সেখানে বহুতল ভবানীগঞ্জ নিউ মার্কেট গড়ে তোলেন।’এমপি থাকাকালে এনামুল স্থানীয় শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগসহ পরিচালনা কমিটি করে দেওয়ার নামে হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার কোটি টাকা। এ কাজে তার সহযোগী ছিল সেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষসহ পরিচালনা কমিটি। ভবানীগঞ্জ সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ ও একাধিক শিক্ষক জানান, এনামুল এমপি থাকার সময় ভাইস প্রিন্সিপালের মাধ্যমে এই এক কলেজ থেকেই প্রায় দেড় কোটি টাকার নিয়োগ-বাণিজ্য হয়েছে। শিক্ষকপ্রতি নেওয়া হয়েছে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা। অনুদানের টাকা এলেও আত্মসাৎ করতেন তিনি। এমন ঘটনা ঘটেছে আরও বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। আক্তার হোসেন নামে বাগমারার এক আওয়ামী লীগ কর্মী বলেন, ‘এনামুলের বিরুদ্ধে বাগমারায় ইটের ভাটা ও জমি দখলের অভিযোগের শেষ নেই। তিনি নৈশপ্রহরী, স্কুল-কলেজে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, তদবির-বাণিজ্য, ইউনিয়ন পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌর নির্বাচনে মনোনয়ন বাণিজ্যেও পটু ছিলেন।’
দুর্গাপুরের আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলম অভিযোগ করে বলেন, ‘ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার নাম করে ১০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন এনামুল।’ শুধু তা-ই নয়, তিনি তার অধীন বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন মাসের পর মাস আটকে রেখেছেন। তবে এনামুল হক বর্তমানে কারগারে থাকায় তার অনিয়ম-দুর্নীতিসহ সার্বিক বিষয়ে বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।(সুত্র -খবরের কাগজ)