তারুণ্যের উচ্ছাসকে কুরআনের আলোয় আলোকিত করতে হবে : সিলেট এমসি মাঠে আজহারী

সুরমা টাইমস রিপোর্ট : তারুণ্যের উচ্ছাস ও লক্ষ লক্ষ তৌহিদী জনতার উপস্থিতিতে সিলেট এমসি কলেজ মাঠে শেষ হয়েছে আনজুমানের ৩ দিনব্যাপী ঐতিহাসিক তাফসীরুল কুরআন মাহফিল। শনিবার শেষ দিনে তারুণ্যের আইডল ড. মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারীর তাফসীর শুনতে দুপুর থেকেই এমসি মাঠমুখী শুরু হয় জনস্রোত। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়তে থাকে উপস্থিতি। বিকেলের আগেই লোকে লোকারণ্য হয়ে যায় এমসি কলেজ মাঠ। সন্ধ্যার পরপরই জনস্রোত ছড়িয়ে পড়ে মাঠের বাইরে আশপাশের এলাকায়। এই মাঠে মাহফিলে এত লোক আগে দেখেনি কেউ। মাঠ ও মাঠের বাইরে প্রজেক্টরের মাধ্যমে ৮টি বড় পর্দায় মাহফিল প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। এই উপস্থিতিকে কুরআনের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ বলে মন্তব্য করছেন উপস্থিত মুফাসসিরগণ।

মাহফিল ঘিরে নগরীর এমসি কলেজ মাঠে বিশাল প্যান্ডেল ও আকর্ষণীয় স্টেজ নির্মাণ করা হয়। বিশেষ করে স্টেজে প্রবেশের রাস্তায় দুই স্তরে মেটাল ডিক্টেটর গেইট নির্মাণ করে পরীক্ষা করে সবাইকে ভেতরে প্রবেশ করানো হয়। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশ, সেনাবাহিনী, র‌্যাবসহ সরকারী সকল সংস্থার সতর্ক অবস্থান ছিল চোখে পড়ার মতো। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে পিডিবির পক্ষ থেকে মাহফিল এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হয়। যানজট এড়াতে নগরের ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় পুলিশ সর্বাত্মক কাজ করে। মাহফিল পাশর্^বর্তী এলাকায় ট্রাক-বাসসহ বড় যান চলাচল সীমিত করা হয়। মুসল্লীদের কেউ অসুস্থ হলে চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়মেডিকেল টিম। মাঠ ও মাঠের বাইরে শতাধিক সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। সিটি করপোরেশন থেকে পর্যাপ্ত লাইট, ওয়াসব্লক স্থাপন এবং পানি পান ও পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা করা হয়। প্রশাসনের পাশাপাশি আনজুমানের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় সাড়ে ৩ হাজারের বেশী স্বেচ্ছাসেবক শৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করেন। মাহফিলের সংবাদ কাভার করতে ঢাকা থেকে আগত এবং সিলেটের স্থানীয় প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক, অনলাইন মিডিয়ার ৩ শতাধিক সাংবাদিককে বিশেষ পাসকার্ড প্রদান করা হয়।

মাহফিলের আগের ২ দিন (১ম ও ২য় দিন) বিকেল ৩টা থেকে রাত ১০ টা পর্যন্ত মাহফিল চললেও, শনিবার শেষ দিন সকাল ১০ টা থেকে বেলা ১২টা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত হয় বিশেষ মহিলা মাহফিল। তখন মাঠে পুরুষ প্রবেশ বন্ধ রাখা হয়। মহিলা মাহফিল শেষে বেলা ১২টার পর ফের শুরু হয় শেষ দিনের মাহফিল, চলে রাত ১০টা পর্যন্ত।

মাহফিলের শেষ দিনের পৃথক অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন আনজুমানে খেদমতে কুরআন সিলেটের সভাপতি প্রফেসর মাওলানা সৈয়দ একরামুল হক ও আল্লামা ইসহাক আল মাদানী।

শেষ দিনে তাফসীর পেশ করেন আল্লামা ইসহাক আল মাদানী, ড. মিজানুর রহমান আজহারী, অধ্যক্ষ মাওলানা আব্দুস সালাম আল মাদানী, মুফতী মাওলানা আমীর হামজা, শায়খ হাফিজ মাওলানা আবু সাঈদ, অধ্যক্ষ মাওলানা লুৎফুর রহমান হুমায়দী, মাওলানা সৈয়দ ফয়জুল্লাহ বাহার, শায়েখ আজমল মসরুর, মাওলানা মাহমুদুর রহমান দিলাওয়ার, মাওলানা মাহবুবুর রহমান জালালাবাদী ও মাওলানা হাসানুল বান্না বিন শরিফ আব্দুল কাদির। মাহফিলে প্রস্তাবনা পেশ করেন মাহফিল বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক হাফিজ আব্দুল হাই হারুন।

তাফসীর পেশ কালে ড. মাওলানা মিজানুর রহমান আজহারী বলেন, ইসলাম হচ্ছে আমাদের জীবন ব্যবস্থা। আমরা কুরআন হাদীসের আলোকে কথা বলি। মানুষকে সচেতন করাই দ্বীনের দ্বায়িদের কাজ। একটি মাহফিলে আমার খন্ডিত বক্তব্য নিয়ে একটি রাজনৈতিক দলের বন্ধুগণের বিতর্ক ছড়িয়ে দেয়া বাক-স্বাধীনতা পরিপন্থী। অথচ আমি কোন দলের নাম উল্লেখ করিনি। এসব ভুলে আমাদেরকে সন্ত্রাস-দুর্নীতিমুক্ত সমাজ গঠনে এগিয়ে আসতে হবে।
আমাদের নিয়ে যারা হিংসা করেন, সমালোচনা করেন আমরা তাদেরকেও ভালবাসি। আমাদের স্লোগান হচ্ছে- হেরে যাবে ওদের হিংসা, জিতে যাবে আমাদের ভালোবাসা। এটাই ইসলামের সুমহান শিক্ষা।

তিনি বলেন, ২৪ এর রক্তাক্ত আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে ফ্যাসিবাদ মুক্ত করেছে আমাদের তরুণ ছাত্র ও যুব সমাজ। এই তরুণদের হাতেই নিরাপদ আমাদের বাংলাদেশ, নিরাপদ লাল সবুজের পতাকা। তরুণ প্রজন্মকে কুরআন-হাদীসের আলোয় আলোকিত করতে হবে। তাহলে দেশ-জাতি সমাজ উপকৃত হবে।আনজুমানে খেদমতে কুরআন সিলেট অঞ্চলের জন্য একটি নেয়ামত। এই সংগঠনটির সাথে শহীদ আল্লামা সাঈদী (র.) এর স্মৃতি জড়িত রয়েছে। সংগঠনটি শুধু দ্বীনের দাওয়াতের কাজ করে না, সামাজিক অঙ্গনে বিশাল ভুমিকা রেখে আসছে। মাহফিলে তিনি আল্লামা ফুলতলী (র.), আল্লামা গহরপুরী (র.), শায়খে কৌড়িয়া (র.) সহ সিলেটের প্রবীণ আলেমদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।

আলোচনা পেশকালে মুফতী আমির হামজা বলেন, বিগত ১৫ বছর ফ্যাসিস্টরা মানুষের কুরআনের কথা শুনা থেকে বিরত রেখেছে। শহীদরা আমাদের সম্পদ। তাদেরকে বিভক্ত করা ঠিক নয়। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে ২০২৪ এর আগষ্ট পর্যন্ত যারা অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবন দিয়েছেন তারা শহীদ। এই তালিকায় আমাদের আল্লামা সাঈদী (র.) রয়েছেন।কারাগার থেকে আমার সামনে দিয়েই সুস্থ অবস্থায় আল্লামা সাঈদীকে বের করে আনা হয়েছিল। এদেশে সকল শহীদদের হত্যার বিচার হবে। আবার আল্লাহর আদালতেও এর বিচার হবে। এজন্য দ্বীন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শামিল হতে হবে। কুরআনের সমাজ বিনির্মাণে কাজ করতে হবে। বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠাই কুরআন সুন্নাহর মূল শিক্ষা।

তিনি বলেন, ৫ আগস্টের পর দেশকে অস্থিতিশীল করার নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম একটি হলো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা উস্কে দেয়া। দেশপ্রেমিক জনতা সকল ষড়যন্ত্র রুখে দিয়েছে। অমুসলিমদের সবচেয়ে বেশী অধিকার দিয়েছে ইসলাম। কোন মুসলমিকে আঘাত করা হলে একটি গোনাহ হবে। আর অমুসলিমকে আঘাত করা হলে ২টি গোনাহ হবে । একটি হলো আঘাতের আরেকটি হলো আমানতের খিয়ানত। অমুসলিম ভাইয়েরা আমাদের কাছে আমানত। পতিত ফ্যাসিস্ট জালিমরা আলেমদের উপর সীমাহিন জুলুম নিপীড়ন চালিয়েছে। তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। পলায়নকারীর তালিকাভুক্ত হওয়ার মাধ্যমে দুনিয়ার সকল জালিমদের জন্য এক দৃষ্টান্ত রেখে গেছে। এক সময়ের মজলুম মানুষ যেন জালিম না হয় সে ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

মাহফিলে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন- মুসলিম কমিউনিটি এসোসিয়েশন ইউকে এন্ড ইউরোপের সেক্রেটারী মাওলানা নুরুল মতিন চৌধুরী, লন্ডন টাওয়ার হ্যামলেটের স্পীকার ব্যারিস্টার সাইফ উদ্দিন খালেদ ও বিশিষ্ট টিভি আলোচক ড. ফয়জুল হক।

এদিকে সকালে অনুষ্ঠিত বিশেষ মহিলা মাহফিলে সভাপতিত্বে করেন মাওলানা হাবিবুর রহমান ও হাফিজ আনওয়ার হোসাইন খান। মাহফিলে আলোচনা শেষে মহিলাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন শায়েখ শাহ মোঃ ওয়ালী উল্লাহ। উপস্থাপনা করেন মাওলানা মাহবুবুর রহমান ও মাওলানা আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ। ক্বেরাত পরিবেশন করেন মুহিউদ্দিন মো: নাকিব। হামদ-নাত পরিবেশন করেন দিশারী শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীবৃন্দ।

শেষ দিনের মাহফিল সঞ্চালনা করেন মাওলানা আব্দুস সালাম মাদানী, হাফিজ মিফতাহুদ্দীন আহমদ, মুফতী আলী হায়দার, ড. মাওলানা এএইচএম সোলায়ামন, মাওলানা মাশুক আহমদ ও মাওলানা সাদিক সিকান্দার। ক্বেরাত পরিবেশন করেন ক্বারী মাওলানা শফিকুর রহমান ও ক্বারী মনজুর বিন মোস্তফা। হামদ-নাত পরিবেশন করেন সুরমা শিল্পীগোষ্ঠী, আহ্বান শিল্পীগোষ্ঠী, মহানগর শিল্পীগোষ্ঠী ও দিশারী শিল্পীগোষ্ঠীর শিল্পীবৃন্দ।

মাহফিলে বক্তারা বলেন, কুরআন ও সুন্নাহ-এর অনুসরণ ছাড়া মুসলমানদের মুক্তি ও কল্যাণের বিকল্প পথ নেই। যারাই কুরআন-হাদীস ও ইসলামের বিরোধিতা করেছে তারা ধ্বংস হয়েছে। যুগে যুগে নবী রাসুলদের উপর নির্যাতন হয়েছে। বিগত সময়ে বাংলাদেশসহ বিশ^ব্যাপী ইসলামপন্থীদের উপরও নির্যাতন হয়েছে। যারা আল্লাহর পথে চলে তারা আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পায়না। আমরা বাংলাদেশীরা একটি ভাগ্যবান জাতি যে, আমরা একটি সাহসী তরুণ প্রজন্ম পেয়েছি। যারা বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ ও নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য বুলেটের সামনে বুক পেতে দেয়। এই জাতিকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারেনা। আমাদের তারুণ্যের এই উচছাসকে কুরআনের আলোয় আলোকিত করতে হবে। তাহলে দেশ জাতি সমাজের পাশাপাশি পুরো বিশ^বাসী এর সুফল লাভ করবে। ইনশাআল্লাহ।

এর আগে মাহফিলের ২য় দিন শুক্রবার (১০ জানুয়ারী) আলোচনা পেশ করেন শায়েখ শাহ মোঃ ওয়ালী উল্লাহ, মাওলানা সাদিকুর রহমান আজহারী, আল্লামা সাঈদী পুত্র শামীম বিন সাঈদী, শায়খ সাঈদ বিন নুরুজ্জামান আল মাদানী, হাফিজ মিফতাহুদ্দীন, ক্বারী মাওলানা মতিউর রহমান ও মাওলানা সাদিক সিকান্দর প্রমূখ।

১ম দিন বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারী) তাফসীর পেশ করেন আন্তর্জাতিক ইসলামিক স্কলার মাওলানা কামরুল ইসলাম সাঈদ আনসারী, মাওলানা আব্দুল্লাহ আল আমীন, প্রিন্সিপাল মাওলানা হাফিজুর রহমান, মাওলানা কমর উদ্দিন, মাওলানা আব্দুস সাত্তার, মাওলানা আব্দুল হাই জিহাদী, শায়খ আব্দুল হক, ড. মাওলানা এএইচএম সোলাইমান ও মাওলানা মাশুক আহমদ।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।