ধর্ষকদের শাস্তির বিধান কোন দেশে কেমন?

সুরমা টাইমস ডেস্ক :

সম্প্রতি ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের ঘটনা দেশজুড়ে ক্ষোভের সৃষ্টি করেছে। ধর্ষকদের শাস্তি নিয়ে আওয়াজ তুলছে মানুষ। আইনি ব্যবস্থা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন।

অনেকের মনেই প্রশ্ন উঠছে দেশে ধর্ষকদের শাস্তির বিধান কী? এর বাইরে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ধর্ষণের মতো অপরাধের শাস্তির বিধানগুলোও আলোচনায় আসছে।

স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয়, সমাজ কোথাও শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধা পর্যন্ত রেহাই পাচ্ছে না একশ্রেণির দুই পায়ের কুকুরের হাত থেকে। কতটা অসহায় হয়ে পড়ছে সমাজ!

এ ধরনের ঘটনায় প্রচলিত ব্যবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত নারীদের আইনি সহায়তা নিতেও নানাভাবে নাজেহাল হতে হয়। যথাযথ সাক্ষী পাওয়ার জটিলতা থেকে শুরু করে দলীয় শেল্টারে থাকা অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনার বিড়ম্বনার কারণে অনেক অভিভাবক আইনের আশ্রয় নিতে অসহায়ত্ববোধ করেন।

 

ফলে অনেক ঘটনা লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়। এরপরও একশ্রেণির জানোয়ার মানসিকতার বিক্রমশালী পুরুষের অযাচিত মুখরোচক কথাবার্তা ক্ষতিগ্রস্তদের আরও একবার ধর্ষণের মত নাজেহাল হতে হয়। এটাই বাস্তবতা। কেউ কেউ আইন সংশোধনের কথাও বলছেন।

 

বাংলাদেশে ধর্ষণের শাস্তি বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে নির্ধারিত। বর্তমানে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

 

২০২০ সালে বাংলাদেশ সরকার ধর্ষণের শাস্তি কঠোর করে ‘নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন’ সংশোধন করেছে।

জনমনে প্রশ্ন উঠছে, কেন বাড়ছে ধর্ষণের মতো পৈশাচিক অপরাধের ঘটনা? এক্ষেত্রে দেশের আইনে শাস্তির বিধান কি অপরাধ বিবেচনায় কম? আর এই অপরাধে শাস্তির বিষয়টি পৃথিবীর অন্যান্য দেশে কেমন?

 

আজকের প্রতিবেদনে জানব ধর্ষণের শাস্তি পৃথিবীর কোন দেশে কেমন।

 

বাংলাদেশ:–

বাংলাদেশে বিদ্যমান আইনে ধর্ষণের ঘটনায় সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। ২০২০ সালের ১৭ নভেম্বর এ আইন পাস করা হয়।

 

সৌদি আরব:–

সৌদি আরবের শরিয়া আইনে ধর্ষণ একটি ফৌজদারি অপরাধ এবং এর শাস্তি হিসেবে দোররা মারা থেকে শুরু করে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।

 

সংযুক্ত আরব-আমিরাত:–

সংযুক্ত আরব আমিরাতের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড। তবে দেশটির আইনে অপরাধ সংঘটনের সময় ভুক্তভোগীর বয়স ১৪ বছরের নিচে হলেই কেবল সেটিকে জোরপূর্বক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

 

ইরান:–
ইরানে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি জনসমক্ষে ফাঁসি কিংবা গুলি করে হত্যা। তবে কখনো কখনো অভিযুক্ত এই সর্বোচ্চ শাস্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়ে যেতে পারে, যদি সে ধর্ষিতার কাছ থেকে ক্ষমা নিয়ে আসতে পারে।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ইরানে মোট ২৫০ জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে, যার মধ্যে ১২ জনকে শাস্তি দেয়া হয়েছে ধর্ষণের দায়ে।

 

যুক্তরাষ্ট্র:–

বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্র যুক্তরাষ্ট্রে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড থেকে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন শাস্তির বিধান রয়েছে।

চীন:–

চীনে কোনো নারীকে ধর্ষণ কিংবা ১৪ বছরের কম বয়সী কোনো মেয়ের সঙ্গে যৌনমিলনের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হতে পারে যদি ভুক্তভোগী মারা যান অথবা মারাত্মকভাবে আহত হন।

তবে সাধারণ ক্ষেত্রে তিন বছর থেকে ১০ বছর কারাদণ্ডের শাস্তি রয়েছে।

 

ভারত:–

২০১৮ সালে পাস হওয়া এক নির্বাহী আদেশে ভারতে ১২ বছরের কম বয়সী মেয়ে শিশু ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড করা হয়।

এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে ধর্ষণ প্রমাণিত হলে ন্যূনতম ১০ বছর শাস্তির বিধান রয়েছে।

 

পাকিস্তান:–

পাকিস্তানের আইন অনুযায়ী ধর্ষণের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা দশ থেকে পঁচিশ বছরের কারাদণ্ড। গণধর্ষণের ক্ষেত্রে শাস্তি মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

 

মিশর:–

মিশরে ধর্ষণ একটি ফৌজদারি অপরাধ যার শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। মামলার পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে এই শাস্তি।

 

ইরাক, বাহরাইন ও উত্তর কোরিয়ায় ধর্ষণের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে।

 

মালয়েশিয়া:–

মালয়েশিয়ায় ধর্ষণ একটি ফৌজদারি অপরাধ, যার মধ্যে স্বামী-স্ত্রীর ধর্ষণও অন্তর্ভুক্ত। সম্মতিহীন যেকোনো যৌনতার জন্য দোষী সাব্যস্ত হলে সর্বোচ্চ ৩০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।

আফগানিস্তান :–

আফগানিস্তানে ধর্ষণের শাস্তি অত্যন্ত কঠোর। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জনসমক্ষে গুলি করে হত্যা করা হয়।

 

উত্তর কোরিয়া :–

উত্তর কোরিয়ায় ধর্ষণের অপরাধে দোষী প্রমাণিত হলে ফায়ারিং স্কোয়াডের মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

 

নরওয়ে ও ইসরায়েল এই রাষ্ট্রগুলোতে ধর্ষণের সাজা ৪ থেকে ১৫ এবং ৪ থেকে ১৬ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

 

বাংলাদেশ পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ৩ হাজার ৯৪৯টি, ২০১৯ সালে ৫ হাজার ৮৭২টি, ২০২০ সালে ৬ হাজার ৫৫৫টি ও ২০২১ সালে ৬ হাজার ৩৪১টি ধর্ষণের মামলা করা হয়েছে।

গত পাঁচ বছরে রাজধানী ঢাকায় ৩ হাজার ৪২টি ধর্ষণের মামলা করা হয়েছে।এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক নারী ২ হাজার ৪৭০ জন এবং শিশু ৫৭২ জন।

২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৫২৩টি। এর মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক নারী ৪৩০ জন এবং শিশু ৯৩ জন।

আমাদের দেশে ধর্ষণ প্রমানের জটিলতার কারণে অনেক প্রভাবশালী আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে বের হয়ে যায়। ফলে প্রচলিত আইনকে আরও সময়োপযোগী করার বিকল্প নেই।

 

প্রমাণ করার পদ্ধতিতে নারী যেন আবার নাজেহালের শিকার না হন, সেদিকটি বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয়ে আমরা নজর দিতে পারি, সেটা হচ্ছে ধর্ষণ মামলার আসামিদের পক্ষে কোনো আইনজীবী আদালতে দাঁড়াবেন না। অপরাধী তার কথা নিজেই বলবে।

 

এভাবে তাকে নিঃসঙ্গ করে দিলে অন্যরাও দুষ্কর্ম থেকে নিবৃত হবে। এসব ব্যাপারে ধর্ষকের মা ও বোনের বক্তব্যও প্রচারে আনা দরকার।

 

এভাবে আইনের প্রয়োজনীয় সংশোধনী ও প্রয়োগের পাশাপাশি সামাজিক প্রতিরোধে এ অপরাধ কমিয়ে আনা সম্ভব।

 

এ কাজ করার জন্য মিডিয়ার পাশাপাশি নারী সংগঠনগুলোকে আরও বেশি সক্রিয় হওয়ার বিকল্প নেই। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালতে আইনি সহায়তার ব্যবস্থা আছে।

 

কিন্তু এসব সুযোগ সম্পর্কে বহু অভিভাবক অথবা ক্ষতিগ্রস্তরা জানেন না। ফলে অনেকে ঝামেলা এড়াতে আদালতের শরণাপন্ন হতে চান না।

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।