বিএনপির নির্বাচন প্রস্তুতি:–
সুরমা টাইমস ডেস্ক :
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে জোট হবে না, এমনটি ধরে নিয়েই এককভাবে ভোটের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে বিএনপি।
চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন মাথায় রেখে ৩০০ আসনের সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীদের একটি তালিকা লন্ডনে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হাতে রয়েছে।
পাশাপাশি সারা দেশে সাংগঠনিকভাবে দলকে শক্তিশালী করতে মাঠ গোছাচ্ছে বিএনপি। দলের সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীরা নিজ নিজ নির্বাচনি আসনে এখন সক্রিয়।
তারা জনসংযোগের পাশাপাশি যোগ দিচ্ছেন সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোতে। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে কাউকে নির্বাচনি প্রচার চালানোর কোনো নির্দেশনা দেওয়া হয়নি বলে দলীয় সূত্রে জানা গেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্য জানান, সম্ভাব্য প্রার্থীরা নির্বাচনি প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে কাউকে দলীয়ভাবে প্রচার চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়নি।
৩১ দফার কর্মশালা, সভা-সমাবেশে দলের ইতিবাচক কর্মকাণ্ড ও চিন্তাভাবনা তুলে ধরছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। তবে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে নির্বাচনে জোট হবে কি না, তা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর চূড়ান্ত হবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। বড় দল হিসেবে সব সময়ই আমাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি থাকে।
নতুন করে প্রস্তুতির কোনো প্রয়োজন নেই।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রার্থীদের তালিকা আগে থেকেই প্রস্তুত থাকে। সময়ের প্রয়োজনে এটা শুধু আপডেট হয়।’
দলীয় সূত্রমতে, আওয়ামী লীগ মাঠে না থাকলেও আগামী সংসদ নির্বাচনকে কিছুটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে বিএনপি।
তাই চলতি বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন হবে এমনটা ধরেই নিয়েই নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে দলটি।
এবারের নির্বাচনে প্রবীণ, অভিজ্ঞ ও তারুণ্যের সমন্বয়ে চূড়ান্ত প্রার্থীদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। ইতোমধ্যে লন্ডনে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হাতে সেই তালিকা জমা দিয়েছে জরিপ টিম।
সেই তালিকায় প্রার্থী নির্ধারণে প্রাধান্য পেয়েছে বিগত নির্বাচনে অংশ নেওয়া দলীয় প্রার্থী, যারা আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন এবং ছাত্রদল থেকে উঠে আসা তরুণ নেতারা।
মূলত ১৯৯১, ২০০১ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেওয়া জনপ্রিয় প্রার্থীরা রয়েছেন। পাশাপাশি ২০১৮ সালে অংশ নেওয়া প্রার্থীরাও আছেন।
তবে এই তালিকা সম্পর্কে অন্য কেউ জানেন না। নির্বাচনের দিনক্ষণ চূড়ান্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত নতুন কেউ যদি জনপ্রিয় বিকল্প প্রার্থী আবির্ভূত হন, তাহলে তখন পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
তবে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্য দলগুলোর নির্বাচনের প্রস্তুতির ওপর নজর রাখছে বিএনপির হাইকমান্ড।
বিএনপির একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রস্তুতি দেখেই আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচনের কার্যক্রম জনসমক্ষে তুলে ধরবে বিএনপি।
আওয়ামী লীগের হামলা-মামলা-সন্ত্রাসে ইতোমধ্যে অনেক প্রার্থী মারা গেছেন। আবার অনেক প্রার্থীর ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংস করে দিয়েছে বিগত স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ।
এ ছাড়া তরুণদের বিষয়টি মাথা রাখা হয়েছে। কারণ তাদের কারণেই এবার গণ-অভ্যুত্থান সফলতা পেয়েছে। প্রার্থী বাছাইয়ে এই বিষয়গুলোও মাথায় রেখেছে হাইকমান্ড।
বিএনপির দলীয় সূত্র জানায়, এবার দলীয় পদ ও সম্ভাব্য এমপি প্রার্থীদের আলাদা করার পরিকল্পনা করেছে হাইকমান্ড। দলের দায়িত্বে যিনি থাকবেন, তিনি সরকারের দায়িত্বে থাকবেন না।
আবার সংসদে যিনি থাকবেন তিনি দলের কোনো দায়িত্বে থাকবেন না, এই রকম সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়েও এগোচ্ছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। নির্বাচনে জয়লাভকারী মোটাদাগে বেশির ভাগ এমপিকে দলীয় পদে না রাখার চিন্তা রয়েছে।
সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পরও অনেককে দলীয় পদ ছাড়তে হবে। তবে এবারের নির্বাচনে ১৯৯১ সাল ও ২০০৮ সালের প্রার্থী তালিকা বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা হবে। বিশেষ করে ২০০৮ সালের প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে জয়লাভকারী ৩০ এমপির বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হবে।
নির্বাচনের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এরই মধ্যে ৬৪ জেলায় সমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বিএনপি। সূচিও প্রকাশ করেছে দলটি। এসব সমাবেশে দলের কেন্দ্রীয় নেতারা অংশ নেবেন।
সমাবেশগুলোতে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি সহনীয় পর্যায়ে রাখা, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি, দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা এবং পতিত ফ্যাসিবাদের নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলার বিষয় অগ্রাধিকার পাবে। সমাবেশের মাধ্যমে নির্বাচনি ক্যাম্পেইন করবে দলটি।
পাশাপাশি সাংগঠনিকভাবে দলকে শক্তিশালী করতে সারা দেশের কমিটিগুলোকে পুনর্গঠন করা হবে। ইতোমধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ ২৫টির বেশি কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে।
বাকিগুলো শিগগিরিই পুর্নগঠন করা হবে। এ ছাড়া দলকে তৃণমূলে শক্তিশালী করতে আগামী ৯০ দিনের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে শুরু করে জেলা কমিটি করতে নির্দেশনা দিয়েছে বিএনপি।
সে লক্ষ্যে সব জেলায় চলছে কাউন্সিল। ১৫ ফেব্রুয়ারি শেষ হবে নির্ধারিত সময়। তবে মার্চ মাসের মধ্যে জেলা-উপজেলার কাউন্সিল শেষ হতে পারে বলে জানা গেছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘২০২৪ সালে নির্বাচনের প্রস্তুতি বিএনপির ছিল।
কিন্তু বিগত সরকারের নির্বাচনের কারচুপির কারণে আমরা অংশগ্রহণ করিনি। কারণ ওই নির্বাচনে গিয়ে নেতৃত্বের শক্তি ও অর্থ ব্যয় করার কোনো মানে নেই।’
তিনি বলেন, ‘বিগত ১৫ বছর ধরে বিএনপির নির্বাচনের প্রস্তুতি অংশ হিসেবে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছে। ঢাকা থেকে শুরু করে মহানগর, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে কর্মসূচি পালন করেছি। নির্বাচনের ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে এসব কর্মসূচি নিয়ে আমরা জনগণের কাছে গিয়েছিলাম।
এগুলো আগামী দিনেও কাজে আসবে। এখন আবার বুধবার (আজ) থেকে সারা দেশে আবারও সাধারণ মানুষের জীবন সমস্যা নিয়ে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামছি। এটাও একধরনের নির্বাচনের ক্যাম্পেইন।’
নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে দলের ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বিগত সময়ে বিএনপি নির্বাচন অংশগ্রহণ করতে চাইলে সরকার করতে দেয়নি।
তারা ভুয়া নির্বাচন করেছে। নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইসহ যেসব কাজ রয়েছে তা আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে না করলেও কিছু কাজ অতীতে এগিয়ে রাখা হয়েছে। পাশাপাশি আমাদের অভ্যন্তরীণ একধরনের প্রস্তুতি রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী একদিকে নির্বাচন পেছানোর কথা বলছে, আরেকদিকে নির্বাচনি এলাকায় প্রার্থী ঘোষণা করছে। এটা চমকপ্রদ ঘটনা মনে হচ্ছে।
নির্বাচন পেছনের কথা বলে কেন তারা প্রার্থী ঘোষণা করবে? তারা একটা অন্য ধরনের সুবিধা নিতে চাইছে। বিশেষ করে তাদের শক্তিমত্তা পরীক্ষা করতে চাইছে।’
জানা গেছে, এবারের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে কোনো জোট করতে ইচ্ছুক নন বিএনপির শীর্ষ নেতা থেকে শুরু করে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও।
বিশেষ করে ধানমন্ডি-৩২ নম্বরের বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনায় নড়েচড়ে বসেছে বিএনপির হাইকমান্ড। জোটবদ্ধ হলে ভবিষ্যতে ভাঙচুরের এই কালিমা বিএনপির নেতা-কর্মীদের ওপর আসতে পারে- এমনটা ধারণা করছেন কেউ কেউ।
যদিও ওই সব ভাঙচুরের ঘটনায় বিএনপির কোনো নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠেনি।
তবে জামায়াতে ইসলামী ছাড়া বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে অন্য যেসব দল ও জোট অংশ নিয়েছে, তাদের নিয়ে আগামী নির্বাচনে অংশ নেওয়ার চিন্তা রয়েছে বিএনপির। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের ব্যানারে ৫৮টি আসন ছেড়ে দিয়েছিল বিএনপি।
তবে এবার সেই আসন সংখ্যা কমে ১৫ থেকে ১০টিতে নেমে আসতে পারে। এরই অংশ হিসেবে গত বছরের ২২ অক্টোবর প্রাথমিকভাবে সমমনা শরিক জোটের ৬ নেতাকে নিজ এলাকায় জনসংযোগে সহযোগিতা করার জন্য দলের সংশ্লিষ্ট ৬ জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের ‘অতীব জরুরি’ নির্দেশনা দিয়ে চিঠি দেয় দলটি।
তবে এ চিঠির ঘটনায় তৃণমূলে ভুল বোঝাবুঝির পরে কেন্দ্রীয় বিএনপির পক্ষ থেকে জানানো হয়, এই চিঠি ধানের শীষের চূড়ান্ত মনোনয়ন নয়।
বরিশাল-৫ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের রহমাতুল্লাহ বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নির্দেশনা দিয়েছেন সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়াতে।
সেই নির্দেশনা মোতাবেক সামাজিক ও রাজনৈতিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমরা ৩১ দফা নিয়ে গণসংযোগ করছি। প্রতিটি মানষের ঘরে ঘরে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।
প্রতি সপ্তাহে ওয়ার্ড, বাজারসহ বিভিন্ন জায়গায় ৩১ দফার লিফলেট বিতরণ করছি। জনগণের কাছে আগামী দিনে কেমন বাংলাদেশ গড়ে তোলা হবে তা তুলে ধরছি।’
নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান জনগণের পাশে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
বিভেদ-বিরোধ ভুলে নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে বলেছেন। পাশাপাশি ৩১ দফা কর্মশালা ও লিফলেট নিয়ে প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে জনগণের কাছে যাচ্ছি।’