চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফসল আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ: ড. ফরহাদ রাব্বী

সুরমা টাইমস ডেস্কঃ

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স এন্ড টেকনোলজি(সিএসই) বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ফরহাদ রাব্বী বলেছেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফসল আগামীর স্মার্ট বাংলাদেশ।

 

টেকসই উন্নয়নের দিকে ক্রমশ ধাবিত হওয়া বাংলাদেশে জ্ঞানভিত্তিক দক্ষতার চেয়ে দক্ষতাভিত্তিক জ্ঞানের এখন বড় প্রয়োজন।তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তিগুলো ব্যবসা,অর্থনীতি,সুশাসন,বিদ্যুৎ,ভূমি ব্যবস্থাপনা সহ বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে।

ফরহাদ রাব্বী রবিবার (১১জুন’২৩) সকালে সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল,সিলেট আঞ্চলিক কার্যালয় কর্তৃক আয়োজিত ” Preparing for the Future:Essential skills for the 4IR” শীর্ষক সেমিনারে মুল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে এসব কথা বলেন।

বিসিসি’র আঞ্চলিক পরিচালক মো. আব্দুল হান্নান চৌধুরীর সভাপতিত্বে উক্ত সেমিনারে আলোচক-১ হিসেবে বক্তব্য রাখেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স এন্ড টেকনোলজি(সিএসই) বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মুমিন,আলোচক-২ হিসেবে বক্তব্য রাখেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইসিটি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. আহসান হাবীব।

মাল্টিমিডিয়া প্রেজেন্টেশনের মাধ্যমে মুল প্রবন্ধে উপস্থাপক অধ্যাপক ফরহাদ রাব্বী বলেন, একটি টেকনোলজি যখন আসে,তখন এর মাধ্যমে নতুন নতুন জিনিস উদ্ভাবন হয় এবং বিশাল পরিবর্তন সাধিত হয়।যেমন প্রথম শিল্প বিপ্লব ঘটেছে স্টীম ইঞ্জিন আবিষ্কারের ফলে। সেসময়ে বাষ্পীয় ইঞ্জিন বা স্টীম ইঞ্জিন যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন এনেছিল। তিনি বলেন, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এপ্লিকেশনগুলোর মধ্যে আছে এআই(আর্টিফিসিয়াল ইনটিলিজেন্স), আইওটি(ইন্টারনেট অফ থিং), ভিআর(ভার্চুয়াল রিয়েলিটি), ব্লক চেইন, বিগ ডাটা ইত্যাদি।

 

এর মধ্যে ড্রাইভিং এর জায়গায় আছে এআই(কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা)।তিনি বলেন, আর্টিফিসিয়েল ইনটিলিজেন্স,ড্রোন,রোবটিক্স,সাইবার সিকিউরিটি সবকিছুই 4IR এর প্রযুক্তির অ়়ংশ। এগুলোর কারণে অনেক কিছু সহজ হয়ে উঠেছে।পরিবর্তন হচ্ছে ব্যাপক। এমন কোন ইন্ডাস্ট্রি নেই যেখানে 4IR এর টেকনোলজি ব্যবহৃত হচ্ছে না। তিনি ই-কমার্সের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ইথিওপিয়ায় কফি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের পণ্য ক্রয় করলে কোন কৃষক কোন পণ্য তৈরি করছে তা তাদের প্রযুক্তির মাধ্যমে জানা যায়।

 

ফরহাদ রাব্বী বলেন, সরকার স্মার্ট বাংলাদেশের চমৎকার ধারণা গ্রহণ করেছে। এর আলোকে শিক্ষাক্ষেত্রেও ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তির আলোকে সিলেবাস ও কারিকুলাম তৈরী করছে।স্কুল কলেজের পাঠ্যসূচীতেও তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।যেটা শিখে বাস্তবে কাজে লাগে সেটিই গ্রহণ করা হচ্ছে।

 

অর্থাৎ আউটকাম বেইজড কারিকুলাম হচ্ছে। তবে শুধু একাডেমিক ফ্রেম ওয়ার্ক নয় এগুলোকে অর্গানাইজেশনাল ফ্রেম ওয়ার্কেও নিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বাজেটেরও প্রয়োজন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এসময়ে বাংলাদেশ ১০টির মতো প্রতিশ্রুতিশীল উদ্যোগও হাতে নিয়েছে।

অধ্যাপক ও গবেষক ফরহাদ রাব্বী বলেন, দুর্যোগ ও সংকটে ঐ প্রযুক্তিগুলো যেমন আমাদের কাজে সহায়তা করে তেমনি এর নেতিবাচক প্রভাবগুলোও মাথায় রেখে কাজ করতে হবে।কোভিড সংকটে আমরা তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে অনেক কাজ করেছি।

 

তিনি বলেন, একটি টেকনোলজি উদ্ভাবন করা যত সহজ প্রয়োগ এর চেয়ে বেশি কঠিন। আবার প্রযুক্তি ব্যবহারে সমস্যায় পড়লে সলুশন যত সহজ তার প্রয়োগ ততটা কঠিন। তাই ব্যবহারের মেথড সহজীকরণ ছাড়া এগুলো সার্বজনীন হবে না।

ফরহাদ রাব্বী বলেন, স্মার্ট এপ্লিকেশন তৈরী করলেই সব সমস্যার সমাধান হবে না। এর সারাউন্ডিং এরিয়া এবং ইউজার স্কিল হতে হবে।আবার খেয়াল রাখতে হবে,প্রযুক্তির মাধ্যমে সমাজে অসমতা(ইন ইকুয়েলিটি)তৈরী হচ্ছে কি না? এটি রিক্সা চালক ব্যবহার করতে পারছে কি না? চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তির প্রসারের ফলে অনেক শিল্প কারখানা নষ্ট হবে, অনেক মানুষ চাকুরী হারাবে এটা যেমন অশনিসংকেত তেমনি আবার নতুন নতুন শিল্প ব্যবস্থা গড়ে উঠবে ও নতুন নতুন কর্মক্ষেত্রেরও আবির্ভাব হবে, এটাও বাস্তব। যেমন, আমরা এখন টেলিভিশন খুব কমই দেখি।তদ্রুপ ফার্ণিচার ,টু্রিজম,

 

গার্মেন্টস এ ব্যাপক পরিবর্তন হবে। ওয়ান মেশিন ও রোবট দিয়ে অনেক মানুষের কর্ম সম্পাদিত হবে। ক্যাপিটাল ফরমেট চেঞ্জ হবে। ফরহাদ রাব্বী বলেন, পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, শতকরা ৮৫ মিলিয়ন জবলেস হবে, শতকরা ৯৭ মিলিয়ন জব রিক্রুট হবে। কিন্তু দক্ষতা সম্পন্ন লোক পাওয়া যাচ্ছে না।
ফরহাদ রাব্বী সংশ্লিষ্ট সকলকে উদ্ভাবনী শক্তির উদ্ভবের আহবান জানিয়ে বলেন, দপ্তরগুলো প্রোএকটিভ হতে হবে।

 

যেমন, আবহাওয়াবিদ জানে বজ্রপাত কোথায় কখন হবে। কিন্তু তিনি এগুলো মানুষের কাছে ব্রডকাস্ট করতে পারছেন না। তথ্য সরবরাহের প্রয়োজনীয় মেথড কিংবা ইকুইপমেন্টস নেই তার কাছে। হাওরাঞ্চলের মানুষের কাছে কিভাবে সহজে মেসেজ প্রেরণ করা যায় তা নিয়ে চিন্তা করতে হবে।

 

BRRI ও ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উদাহরণ দিয়ে তিনি কৃষি ও স্বাস্থ্য সেক্টরের কথা তুলে ধরে বলেন, 4IR অভাবনীয় সাফল্য নিয়ে আসবে শীঘ্রই।প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করার জন্য জাতীয় নীতিমালাও তৈরী করা হয়েছে। যাতে কেউ কোন ক্রাইম বা অপ্রত্যাশিত কোন ঝুঁকিতে কেউ না পড়ে।

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ আল মুমিন বলেন, 4IR এবং এর টেকনোলজি টক অব দ্যা প্লানেট।এবং 4IR ড্রাইভ করছে এআই(আর্টিফিসিয়াল ইনটিলিজেন্স), ই-কমার্স। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রযুক্তির উদ্ভাবকের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 4IR এর উদ্ভাবক বলেছেন, এলিয়েনরা পৃথিবীতে ল্যান্ড করেছে। দ্যা আর স্পিকিং ইন গুড ইংলিশ।

 

সম্প্রতি তিনি গোগল থেকেও লিভ করেছেন। ড. আব্দুল্লাহ আল মুমিন বলেন, আমাদেরকে ফোর আইআর এর নীতিমালা মেনে চলতে হবে। নৈতিকতা মেনে চলতে হবে। 4IR এর প্রযুক্তিগুলো মৌলিক চাহিদা পূরণ করছে কিনা সেদিকে দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন।তিনি বলেন, এখন গ্লোবাল মার্কেটের যুগ। গার্ডেনিং, এগ্রিকালচার কিংবা হেলথ যে কোনো সেক্টরের সুফল সবাই পাবে অতি সহজে।

 

তিনি উন্নত বিশ্বের দিকে না তাকিয়ে বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে প্রযুক্তিগুলোকে কাজে লাগানোর আহবান জানান। প্রযুক্তি হবে সার্বজনীন এ কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, 4IR মানুষের জীবনযাত্রায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন নিয়ে আসবে। দেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

ড. আহসান হাবীব বলেন, জ্ঞানভিত্তিক সমাজের বদলে আমাদেরকে দক্ষতাভিত্তিক সমাজ গঠনে অগ্রসর হতে হবে।এই সময়ে থিওরিটিক্যল নলেজের চেয়ে কারিগরি ও ব্যবহারিক শিক্ষাটা খুব জরুরী। শিশুদের ঘরে বসে সাঁতার কাটার প্রশিক্ষণের চেয়ে পুকুরে সরাসরি তা শিখানো বেশি ভালো উল্লেখ করে তিনি বলেন,দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্র বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে।

 

তিনি বলেন,চীনারা প্রযুক্তিতে অনেক এগিয়ে। তাই চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের উপকার পেতে হলে মাইন্ড সেটাপ করতে হবে। ফেসবুকের উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, এখানে মানুষ বিজ্ঞাপন দেয়। মুহুর্তের মধ্যে সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে।ফেসবুক তার ইউজারের সেন্সর এখন বুঝতে পারে তাই যে যেটা ভাবে এটাই তার সামনে চলে আসে। তিনি বলেন, দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব ছিল ইলেকট্রিসিটি ও টেলিগ্রাফে, তৃতীয় শিল্প বিপ্লব ছিল আইটি ও ইন্টারনেট, আর এখন হলো এডভান্স আইটি, ডিজিটালাইজেশন।তিনি বলেন, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে হলে আমাদেরকে আগে স্মার্ট সিটি,স্মার্ট পুলিশ, স্মার্ট জার্নালিস্ট, স্মার্ট ক্যাম্পাস ইত্যাদি অর্গানগুলোকে উপযোগী করে তৈরী করতে হবে।

 

এর মাধ্যমে স্মার্ট গভর্ণনেন্স, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট সিটিজেন গড়া হবে। তিনি বলেন, শাবিপ্রবির শিক্ষার্থীদের জন্য ১৯৯১ সাল থেকে আইটি বাধ্যতামূলক সাবজেক্ট।পরবর্তীতে আমরা থার্ড আইআর যোগ করেছি।

 

এখন যোগ হয়েছে ফোর্থ আইআর।তিনি বলেন, ইন্ডাস্ট্রির সাথে মিল রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের কারিকুলাম হওয়ায় কোর্স শেষ হওয়ার আগেই কোম্পানীগুলো ভিড় জমায়। তিনি বলেন, আগে আইকিউ ছিল বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক প্রশ্ন, এখন ইকিউ ইমোশনাল কোয়েশ্চন। এটি ফোর আইআর এর প্রভাবক।

বিসিসি’র সিলেট আঞ্চলিক কার্যালয়ের সিস্টেম ম্যানাজার গোলাম রাব্বানীর পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সেমিনারে মুক্ত আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন, লিডিং ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ড. শামসাদ কিবরিয়া, সিলেট সরকারি টিচার্স ট্রেনিং কলেজের সহকারি অধ্যাপক দিদার চৌধুরী, সিলেট অনলাইন প্রেসক্লাবের সভাপতি মুহিত চৌধুরী, বিটিসিএল এর ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার মিহির কর, মনিরুজ্জামান প্রমুখ।

সভাপতির বক্তব্যে আব্দুল হান্নান চৌধুরী বলেন, দক্ষতার আপডেট করতে হবে। এর বিকল্প নেই। আমরা শিল্প বিপ্লব অনেক শুনেছি। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় পাইনি, চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শেষ পর্যায়ে। মানুষ ৫ম শিল্প বিপ্লবের কথা বলছে। আমরা অনেক পিছিয়ে। ইউরোপ আমেরিকা যখন ফল ভোগ করতে শুরু করে তখন আমরা কাজে নামি। তাই আমাদের এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।

 

তিনি জানান, বিসিসি সিলেটে শীঘ্রই ST exam system চালু করবে। এটি জাপান থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। এখানে বিভিন্ন লেভেলে কাজ হয়। ইউজিসি এ ব্যাপারে ইউনিভার্সিটিগুলোকে ইতোমধ্যে চিঠিও দিয়েছে।

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।