সাব- রেজিস্ট্রার লুৎফর নিজে বেতন পান ৭০ হাজার, থাকেন ২ কোটি টাকার ফ্ল্যাটে
সুরমা টাইমস ডেস্ক : – রাজধানীর শান্তিনগর মোড়সংলগ্ন আবাসিক ভবন ইস্টার্ন পয়েন্ট। বহুতল এই ভবনের ৬০২ নম্বর ফ্ল্যাটে পরিবার নিয়ে বসবাস করেন উত্তরার সাব-রেজিস্ট্রার লুৎফর রহমান মোল্লা। ১ হাজার ৮৫০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটটি তাঁর কেনা। মূল্য কমপক্ষে ২ কোটি টাকা। ভবনের একজন নিরাপত্তাকর্মী বলেন, ‘লুৎফর স্যার আগে ১ নম্বর ভবনের একটি ফ্ল্যাটে ভাড়া থাকতেন। পরে ২ নম্বর ভবনের একটি ফ্ল্যাট কিনে সেটিতে থাকেন।’ আরও কয়েকজন নিরাপত্তাকর্মী একই তথ্য জানান।
শুধু এই ফ্ল্যাট নয়; ঢাকায় লুৎফর মোল্লার আরও দুটি ফ্ল্যাট, একটি প্লট এবং গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর শহরে তিনটি বহুতল ভবন রয়েছে। পাশাপাশি বিঘা বিঘা জমির মালিকও তিনি।
বহু বছর চাকরি করার পর বর্তমানে এই কর্মকর্তা বেতন পান সব মিলিয়ে সর্বোচ্চ ৭০ হাজার টাকা। এর পরও এত সম্পদ গড়ায় নানা প্রশ্ন সবার। লুৎফর রহমান মোল্লা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা তিনটি ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার করেন– দুটি প্রাইভেটকার ও একটি নোয়াহ মাইক্রোবাস। দু’জন ড্রাইভার। তাদের বেতন ৪০ হাজার টাকা। একটি প্রাইভেটকারে তিনি অফিসে যাতায়াত করেন, আরেকটিতে ছেলে ও স্ত্রী চলাচল করেন। মাঝেমধ্যে মাইক্রোবাসটি ব্যবহার করেন। তিনটি গাড়ির মধ্যে একটি তাঁর স্ত্রী শারমিন রুমির নামে। সমকালের অনুসন্ধানে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারি কর্মকর্তার নামে অঢেল সম্পদ থাকলে আইনি জটিলতায় পড়তে পারেন– এ আশঙ্কায় লুৎফর রহমান মোল্লা বেশির ভাগ সম্পদ গড়েছেন বেনামে। কিছু ক্ষেত্রে ছোট ভাইয়ের নামে জমি কিনে পরে নিজের নামে হেবা করিয়েছেন। পরে ছোট ভাইয়ের কাছ থেকে দানসূত্রে জমি পেয়েছেন বলে দলিল করেছেন। এমন দুটি দলিলের অনুলিপি সমকালের হাতে এসেছে।
লুৎফর রহমান ২০১৬ সালের দিকে সাতক্ষীরা সদর সাব-রেজিস্ট্রার ছিলেন। জাল দলিল করার অভিযোগ আছে তাঁর বিরুদ্ধে। ওই বছরের ১৫ মে তিনি ও দলিল লেখক মুনসুর রহমান জাল দলিল করার কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) হাতে আটক হয়েছিলেন।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে ১৮৯ জনের সাব-রেজিস্ট্রার পদে চাকরি হয় উচ্চ আদালতের নির্দেশে। তাদের মধ্যে লুৎফর রহমান একজন। যদিও ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর বয়স ছিল পাঁচ বছরের মতো।
মাদারীপুরে লুৎফর রহমানের এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, সাবরেজিস্ট্রার হিসেবে চাকরিতে প্রবেশের আগে লুৎফর স্থানীয় আমিনের সহকারী ছিলেন।
লুৎফর মোল্লা মাদারীপুর শহরের কলেজ রোড এলাকার প্রয়াত সাত্তার মোল্লার ছেলে। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাঁর বাবা ছিলেন দিনমজুর। ভিটের জমি ছাড়া কোনো সম্পদ ছিল না। পাঁচ ছেলের মধ্যে লুৎফর চতুর্থ। তাঁর বড় তিন ভাই মারা গেছেন। ছোট ভাই লোকমান মোল্লা। অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর সম্পদের মালিক হওয়ায় শহরে আলোচনায় লুৎফর মোল্লা ও লোকমান মোল্লা।
এলাকার একাধিক মানুষ জানান, এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করা লোকমান মোল্লা নব্বই দশকে ছয়-সাত বছর যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। দেশে ফেরার পরও তাঁর এত সম্পদ দেখা যায়নি। মূলত ২০১২ সালের পর প্রচুর সম্পদ কেনেন তিনি। মার্কেট, হাসপাতাল, ইটের ভাটা, মাছের ঘের, জুট বাইন্ডিং মিলের মালিক হন। ভাই লোকমানের নামে লুৎফর রহমান মোল্লা অনেক সম্পদ গড়েছেন বলে এলাকায় চাউর আছে।
গত ১ অক্টোবর মাদারীপুর শহরের কলেজ রোডে গিয়ে দেখা যায়, কলেজের উত্তর পাশের ফটক থেকে ১০০ গজ দূরে রাস্তার পাশে একটি ছয় তলা ভবন। পাঁচ তলা পর্যন্ত সম্পন্ন করা হয়েছে, ছয় তলায় ছাদ দেওয়া আছে। প্রায় ৮ শতাংশ জমির ওপর নির্মিত ভবনটির প্রতি তলায় তিনটি করে ইউনিট। সেগুলো ভাড়া দেওয়া আছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ভাড়াটিয়া সমকালকে জানান, তিনি লুৎফর রহমানের বাড়ির একটি ফ্ল্যাট ৭ হাজার টাকায় ভাড়া নিয়েছেন।
এলাকাবাসী জানিয়েছেন, এই বাড়িতে ২০২৩ সালের অক্টোবরে এক রাতে মদপানে সাগরিকা ও পারুল নামে দুই নারীর মৃত্যু হয়। এর পরই বাড়িটির মালিক যে লুৎফর মোল্লা, তা জানাজানি হয়।
জেলা শহরের মাস্টার কলোনি মসজিদ থেকে পূর্ব দিকে গেলে ছোট পুকুরপাড়ে দেখা যায় পাঁচ তলা দুটি নির্মাণাধীন বাড়ি। এগুলোর মালিকও লুৎফর। একটি বাড়ির চার তলা পর্যন্ত ছাদ সম্পন্ন হয়েছে। ভবনের পঞ্চম তলায় মিস্ত্রিদের কাজ করতে দেখা যায়। কথা বলে জানা গেল, বাড়িটির তিন তলা পর্যন্ত কাজ আগে সম্পন্ন হওয়ায় সেগুলো ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এর পাশেই আরেকটি পাঁচ তলা ভবন নির্মাণাধীন। এটিও লুৎফর মোল্লার। দোতলা পর্যন্ত সম্পন্ন করে ভাড়া দিয়েছেন। দুটি ভবনের প্রতি তলায় তিনটি করে ইউনিট। প্রতিটি ভবন একই নকশায় তৈরি করা।
স্থানীয় ভূমি অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লুৎফর মোল্লা ২০১২ সালের নভেম্বরে ১১১ শকুনী মৌজার ৩৯ নম্বর দাগের ৪ শতাংশ জমি কেনেন। দলিলে দাম দেখানো হয়েছে ১৩ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। শহরের সৈদার বালি এলাকার পারুল বেগম ও কানিজ ফাতেমার কাছ থেকে কেনা।
এলাকাবাসীর ভাষ্য, লোকমান মোল্লা তাঁর ভাই লুৎফরকে জমি দানপত্র করেছেন– এটা এলাকায় জানাজানি হলে হাস্যরস সৃষ্টি হয়। লুৎফর ও লোকমানের প্রয়াত তিন ভাইয়ের ছেলেরা আর্থিকভাবে তেমন সচ্ছল নন। লোকমান তাদের জায়গাজমি দান করলেন না, আর কোটিপতি লুৎফরকে বাড়িসহ জমি দানপত্র করে দিলেন?
খালি জমি কিনে পরে ছয় তলা বাড়ি
২০২২ সালের আগস্টে ৬৩৭২ নম্বর দলিলমূলে ১১১ শকুনী মৌজার বিআরএস ১১৩৬ নম্বর দাগের ৭ শতাংশ জমিসহ নির্মাণাধীন ছয় তলা ভবন লুৎফর রহমান মোল্লাকে হেবা করে দেন লোকমান মোল্লা। দলিলে বলা হয়েছে, এই জমি লোকমানের নামে কেনা হয়েছিল। স্থানীয়দের মতে, সেখানে ৭ শতাংশ জমির মূল্য আনুমানিক দেড় কোটি টাকা। আর ছয় তলা ভবনের মূল্য আরও প্রায় দেড় কোটি টাকা।
২০২২ সালে আরও একটি জমি লোকমান মোল্লা তাঁর ভাই লুৎফর রহমানকে দানপত্র করে দেন। জমির পরিমাণ ৬ শতাংশ। এটিও শহরের শকুনী মৌজায়। দলিল ঘেঁটে দেখা গেছে, জমিটি ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল মেজবাহুল আলম গংয়ের কাছ থেকে লোকমান মোল্লার নামে ক্রয় করা হয়। দলিলে উল্লেখ করা হয়, ‘হেবার ঘোষণাপত্র দলিলের গ্রহীতা আমার সহোদর। আপনি সেবাযত্নে, চাল-চলনে, আচার-আচরণ, কথাবার্তায় আমাকে মুগ্ধ করেছেন। আমাকে স্নেহ-আদর দিয়ে বড় করেছেন। আমিও ভক্তি-শ্রদ্ধা করি। তাই আপনার ওপর সন্তুষ্ট হয়ে, আপনার ভবিষ্যৎ সুখ-শান্তির কথা চিন্তা করে তপশিলে বর্ণিত সম্পত্তি রেজিস্ট্রি করে দিলাম।’ স্থানীয়রা জানান, ৬ শতাংশ জমির মূল্য এক কোটি টাকার ওপরে।
হাসপাতালের ডিএমডি লুৎফরের স্ত্রী
লোকমান মোল্লার মালিকানায় রয়েছে কলেজ রোডে প্লানেট হাসপাতাল (প্রা.)। হাসপাতালের জমি ও ভবন তাঁর। এর উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) লুৎফর মোল্লার স্ত্রী শারমিন রুমি। হাসপাতালটির চিকিৎসক হিসেবে রয়েছেন তাদের মেয়ে রুবাইয়া রহমান। তাঁর স্বামী ডা. জোয়ারদার রাকিন মনজুরও এ হাসপাতালে বসেন।
হাসপাতালের পেছনেই দুটি চার তলা আবাসিক ভবন রয়েছে লোকমান মোল্লার। এ ছাড়া ডিসি ব্রিজ এলাকায় চার তলা একটি ভবন রয়েছে তাঁর, যার নিচতলা ‘স্বপ্ন শপিং’ সেন্টারকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। তার পেছনে রয়েছে আরেকটি একতলা ভবন আর সামনে কয়েকটি দোকান। এগুলোর মালিক লোকমান মোল্লা বলে জানেন এলাকাবাসী।
সরেজমিন দেখা যায়, মাদারীপুর ইউনাইটেড সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পশ্চিম ফটকসংলগ্ন লোকমানের আরও তিনটি তিন তলা ভবন রয়েছে। সেখানে সাইনবোর্ডে লেখা ‘প্লানেট হাউজিং প্রকল্প’। মাদারীপুর পৌর বাস টার্মিনালের পশ্চিম পাশে রয়েছে একটি দোতলা ভবন। নিচতলায় মার্কেট আর দোতলায় কমিউনিটি সেন্টার করা হয়েছে। এটির মালিকও লোকমান মোল্লা। এ ছাড়া রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ী এলাকায় ইটের ভাটা, মাছের ঘের ও একটি জুট বাইন্ডিং মিল রয়েছে। গাজীপুরেও লোকমানের কয়েক একর জমি রয়েছে বলে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে লুৎফর রহমান মোল্লা সমকালকে বলেন, ‘বর্তমান যে প্রেক্ষাপট, তা তো ভালো না। আমি জানামতে চাকরির পর এক ইঞ্চি জমিও কিনি নাই। আমার ছোট ভাই (লোকমান মোল্লা) কিনছে। ছোট ভাই পরবর্তী সময়ে সেই অবস্থায় যা করার করছে। আমি জানি সম্পত্তি নিয়ে সমস্যা হবে। তাই আগে থেকেই মোটামুটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, এই অপশনে যাব না। ব্যাংক থেকে শতভাগ ঋণ নিয়ে বাড়ি করছি। তিনটি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছি।’(সুত্র -সমকাল)