বিবেকের কণ্ঠস্বরের বিদায়!
হাবিবুর রহমান তাফাদারঃ মেধাবীরা যেখানে দেশ ছেড়ে পালাতে পারলেই বাঁচে। সেখানে উনি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে ডাক্তারি পড়ালেখা শেষ না করেই বিলেত থেকে দেশে ছুটে আসেন। যুদ্ধাহতদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল গড়ে তোলার কাজ শুরু করেন।
টগ বগে এক তরুণ শুধু মাত্র দেশ মাতৃকার স্বার্থে লেখাপড়া ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন কল্পনা করা যায়? আমাদের সরকারের মন্ত্রী আমলারা নিজ দেশে এমন চিকিৎসালয় বানান যেখানে তারা নিজেরাই চিকিৎসা নেন না।
এমন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বানান যেখানে তাদের নিজ সন্তানদের পড়ান না।
এইরকম হিপোক্রেট রাজ্যে ডাক্তার জাফরুল্লাহ চৌধুরী ব্যতিক্রমী একজন মানুষ। তিনি সাধারণ মানুষের জন্য গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতাল নামে একটি হাসপাতাল গড়ে তুলেন যেখানে গরিব মানুষের জন্য কিডনির ডায়ালিসিস থেকে শুরু করে নানা জটিল রোগের চিকিৎসা অত্যন্ত স্বল্পমূল্যে করার ব্যবস্থা করেছেন এবং মৃত্যুর আগ পর্যন্ত নিজের কিডনির চিকিৎসা ও ডায়ালিসিসও সেখানেই করিয়েছেন।
নানা সময় সিএমএইচ বা পৃথিবীর সেরা হাসপাতালে বিনা পয়সায় চিকিৎসার অফার পেলেও রাজি হন নি। উনার উন্নত অপারেশনের জন্য অফার পেয়েছিলেন আবার কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করার জন্যও অফার পেয়েছিলেন। কোনদিন কোন চিকিৎসা নিজের তৈরী গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ছাড়া করাননি। কারণ উনি হিপোক্রিট না।
অন্যের চিকিৎসার জন্য যেই কেন্দ্র গড়ে তুলবেন সেখানে নিজে চিকিৎসা না করলে তার উপর মানুষের আস্থা আসবে কি করে? এটাই ছিলো উনার মুখের কথা। দেশের টানে যেমন দেশে ফিরে এসেছিলেন। সব সক্ষমতা থাকার পরও নিজ দেশেই , নিজের হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে নিজ দেশের মাটিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন।
থেমে গেলো আরেকটি বিবেকি কণ্ঠ। চলে গেলেন মহান মুক্তিযুদ্ধের আরো এক কিংবদন্তী। দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের জন্য মুক্তকণ্ঠ হয়ে উঠা বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী আর নেই (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মঙ্গলবার রাত ১০টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার মৃত্যুতে শোকের ছাড়া নেমে এসেছে তার সকল মহলে। বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন বিশিষ্টজন, রাজনীতিবিদসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ।
আচার আর আচরণে যেখানে মানুষের যোজন যোজন তফাত, সেখানে জাফরুল্লাহ চৌধুরি ছিলেন অনন্য। এই অনন্য, নিঃস্বার্থ, দেশপ্রেমিক মানুষের মহাপ্রয়াণ হলো আজ। জানিনা, এরকম এক আলোক জ্যোতির জন্ম এই দেশে আর হবে কিনা।
সর্বশেষ ২৬শে মার্চ বঙ্গভবনে আয়োজিত প্রেসিডেন্টের দেয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নেন হুইল চেয়ারে বসে। এদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পাশে দাঁড়িয়ে তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন। বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি অনেক সম্মাননা ও অর্জন করেন। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে অনন্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ তিনি ১৯৭৭ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও তিনি ফিলিপাইন থেকে র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কারে ভুষিত হন ১৯৮৫ সালে। সুইডেন থেকে বিকল্প নোবেল হিসাবে পরিচিত রাইট লাভলিহুড পুরস্কার পান ১৯৯২ সালে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ (২০০২) এবং মানবতার সেবার জন্য কানাডা থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিও অর্জন করেন তিনি। ২০২১ সালে আহমদ শরীফ স্মারক পুরস্কার পান ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ছিলেন বর্ণাঢ্য এক জীবনের অধিকারী। স্বাধীন দেশে তিনি হতে পারতেন দেশসেরা সার্জন। কিন্তু লড়াকু মানুষ ডা. জাফরুল্লাহ স্বাধীন দেশে নিজেকে নিয়োজিত করেন গণমানুষের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নারীদের করেন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকর্মী। প্রথম উদ্যোগ নেন জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের। জনকল্যাণধর্মী চিকিৎসানীতির মাধ্যমে দেশে ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার নীতি প্রণয়ন, জাতীয় শিক্ষা কমিটির সদস্য হিসেবে অগ্রসর শিক্ষা নীতি প্রণয়ন ও নারী উন্নয়নে রাখেন যুগান্তকারী ভূমিকা। সরকার ও রাষ্ট্রের, ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর যেকোনো অনিয়মের বিরুদ্ধে তিনি দাঁড়িয়েছেন বুকচিতিয়ে। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ-পরিস্থিতি যখন উত্তপ্ত, অনিশ্চিত হতো তখনই বিবদমান পক্ষের মাঝখানে সমঝোতার সেতুর ভূমিকা নিতেন এই বীর যোদ্ধা। রাষ্ট্রক্ষমতার বাইরে থেকে একজন ব্যক্তিমানুষের পক্ষে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য যতটুকু কাজ করা সম্ভব তার পুরোটাই করেছেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারের সময়ে মন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দেন ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মহান রাব্বুল আলামিন এই কর্মবীর, দেশ প্রেমিক মানুষটিকে জান্নাতবাসী করুন।