উন্নয়ন সহযোগীদের প্রকল্পে স্থবিরতা

সুরমা টাইমস ডেস্ক : আকস্মিক রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও দেশব্যাপী চলমান অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে ভারত, চীন, জাপান ও রাশিয়াসহ বেশ কয়েকটি উন্নয়ন সহযোগী দেশের চলমান প্রকল্প বাস্তবায়নে স্থবিরতা বিরাজ করছে। কোনো কোনো প্রকল্পের কাজও বন্ধ রয়েছে। আবার কয়েকটি দেশ থেকে ঋণ ছাড়ও বন্ধ হয়ে গেছে। পাশাপাশি নানা জায়গা থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগে এই স্থবির পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পগুলোতে কাজ বন্ধ থাকলে মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি হতে পারে। এভাবে চললে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন, বৈদেশিক অর্থছাড় ও প্রকল্পগুলো থেকে প্রত্যাশিত সুফল পাওয়ার ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে।

সূত্র জানায়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে দেশের পরিবহন ও যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি, শিক্ষা, গৃহায়ন, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়ন, স্বাস্থ্য, কৃষি, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রকল্প নেয়া হয়। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছর বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) প্রকল্পের সংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৩৫২টি। প্রতি বছরের বাজেটেই প্রকল্পগুলোতে দিতে হয় মোটা অঙ্কের বরাদ্দ। এসব প্রকল্পে উন্নয়ন সহযোগী কয়েকটি দেশ থেকে অর্থ ছাড় বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে বেশ কিছু প্রকল্পে কাজ বন্ধ রয়েছে। যেমন; চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাস জুলাই-সেপ্টেম্বরে চীনের কাছ থেকে কোনো অর্থ পায়নি বাংলাদেশ। এমনকি এই সময়ে কোনো নতুন ঋণের প্রতিশ্রুতিও দেয়নি দেশটি। সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রকাশিত হালনাগাদ প্রতিবেদনে চীনের ঋণ ছাড় না হওয়ার এই তথ্য পাওয়া গেছে। তবে উন্নয়ন সহযোগী দেশগুলোর ঢাকায় নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতরা আশ্বস্ত করেছেন, বাংলাদেশে বাস্তাবায়নাধীন প্রকল্পগুলো পরিকল্পনা অনুযায়ী চলমান থাকবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বেশ কিছু প্রকল্প নেয়া হয়েছে যেগুলোর অর্থনৈতিক গুরুত্ব কম। এরমধ্যে কিছু নেয়া হয়েছে রাজনৈতিক বিবেচনায়। অস্বাভাবিক ব্যয়ের অভিযোগও রয়েছে। পাশাপাশি অর্থ ছাড় বন্ধ হওয়ার পাশাপাশি চাঁদাবাজির কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন তারা।

সূত্র মতে বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত ডুয়েল গেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির সভা সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক সূত্র জানায়, প্রকল্পে প্রতিশ্রুত ঋণের টাকা দিচ্ছে না ভারত। প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধিতে যে বাড়তি ঋণ প্রয়োজন, সে বিষয়েও কিছু বলছে না দেশটি। ফলে অনিশ্চয়তায় পড়েছে প্রকল্পটি। সম্প্রতি রেল সচিব আবদুল বাকীর সভাপতিত্বে স্টিয়ারিং কমিটির সভা হয়। সভার নথি সূত্রে জানা গেছে, ৫ হাজার ৫৮০ কোটি টাকা ব্যয় প্রাক্কলন করে প্রকল্প অনুমোদন করা হয় ২০১৮ সালে। তখন পরিকল্পনা ছিল ২০২৩ সালের জুনে কাজ সম্পন্ন হবে। পরে মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। ফলে প্রকল্প মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। ৩১শে অক্টোবর পর্যন্ত প্রকল্প অগ্রগতি মাত্র ১৬ শতাংশ। এ প্রকল্পের পরিচালক মো. মনিরুল ইসলাম ফিরোজী বলেন, কাজ বন্ধ বলা যায় না, স্থবির হয়ে গেছে। তবে চাঁদাবাজি হয়নি বলে তিনি জানান।

আরেকটি সূত্র জানায়, গত ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করা ভারতীয়রা দেশে ফিরে গেছে। গত ৩০শে আগস্ট নয়াদিল্লিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হলে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে পরামর্শ করে চলমান প্রকল্পের কাজ শুরু হবে।

এ ছাড়া সরকার পরিবর্তনের পর ভারতীয় ঋণের অর্থে নির্মাণাধীন কুলাউড়া-শাহবাজপুর রেলপথ প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয়ে গেলেও সপ্তাহ খানেক হলো আবার চালু হয়েছে।

এদিকে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বেশ ঘটা করে ঘোষণা দেয়া হয়েছিল দেশের ১২টি জেলায় নির্মাণ করা হবে আইটি পার্ক। এজন্য প্রকল্প বাজেট নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা। ভারতীয় ঋণে ওই প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়। জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৫শে এপ্রিল একনেকে প্রকল্পের বাজেট অনুমোদন করা হলেও কাজ শুরু করা হয় ২০২২ সালের নভেম্বরে। কিন্তু গত ৫ই আগস্ট দেশের পট পরিবর্তনের পর পাল্টে গেছে ওই প্রকল্পের চিত্র। প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে বর্তমানে কোনো অর্থও ছাড় করছে না ভারত। এ কারণে পুরো প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে। প্রকল্পটির পিডি একেএএম ফজলুল হক বলেন, নানা কারণে আপাতত প্রকল্পের কাজ বন্ধ রয়েছে।

ওদিকে ৬ প্রকল্পে অর্থছাড় বন্ধ রেখেছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। চলমান ঋণ পরিশোধের নিশ্চয়তা চায় দেশটি। ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশ চলমান বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করতে পারবে কিনা, তা নিয়ে শঙ্কায় আছে চীন। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে দেখা দিয়েছে একরকম স্থবিরতা। শেষ সময়ে এসে মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি হতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এর দায় নেবে কে? এমন প্রশ্নও উঠেছে।

এদিকে বিশেষায়িত কোম্পানির অংশীদারিত্ব নিয়ে সমাধান না হওয়ায় র‌্যাপিড পাস ও এমআরটি পাসের ক্লিয়ারিং হাউজ কার্যক্রম থেকে সরে দাঁড়িয়েছে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা)। তবে চালু রয়েছে র‌্যাপিড পাস। নতুন করে ক্লিয়ারিং হাউজের কারিগরি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে কাজ করছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। ডিটিসিএ সূত্রে এ কথা জানা গেছে। জাপানি বিশেষজ্ঞ দল চলে গেলেও র‌্যাপিড পাস নিয়ে কোনো সমস্যা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক মো. মামুনুর রহমান। গত ১৫ই অক্টোবর এই প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত করা হয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞ দল হঠাৎ চলে যাওয়ায় হয়তো আরও দুই বছর সময় লাগবে। প্রকল্পের অগ্রগতি ৫২ শতাংশ।

ওদিকে কক্সবাজারের মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্পেও অচলাবস্থা বিরাজ করছে। প্রকল্পের ইউনিট কমিশনিংয়ের জন্য জাপানের সুমিতমো করপোরেশনের মাধ্যমে কয়লা আনা হয়। গত আগস্টে জাপানি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে চুক্তি শেষ হয়। কয়লা সংকটে বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিটের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে।

এদিকে বাতিল হচ্ছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ প্রকল্পের কাজ। বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ওই প্রকল্প নিয়ে কোনো ধরনের কাজ করতে চান না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। উল্টো রাশিয়ার সঙ্গে যে ধরনের চুক্তি হতে যাচ্ছিল তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বিশেষ করে স্যাটেলাইট প্রকল্পের জন্য যে সফটলোনের প্রস্তাব বাংলাদেশ করেছে তার বিপরীতে উচ্চ ইন্টারেস্ট দাবি করেছে রাশিয়া। এরমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের আর্থিক অনিয়মের ঘটনা থাকতে পারে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এদিকে রাশিয়ার অর্থায়নে নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ঋণ ও সুদ পরিশোধের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের এসক্রো অ্যাকাউন্টে ৮০৯ মিলিয়ন ডলার জমা হয়েছে। এসক্রো হলো লেনদেনের অর্থ ও সম্পদ তৃতীয় পক্ষের অ্যাকাউন্টে জমা রাখা। তারপর চুক্তির সব শর্ত পূরণ হলেই তা সংশ্লিষ্ট পক্ষের কাছে পাঠানো হয়। ২০১৬ সালে রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য রাশিয়ার কাছ থেকে ১৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিতে রাজি হয়েছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সুদের পাশাপাশি দশ শতাংশ অগ্রিম পরিশোধের কথা থাকলেও নিষেধাজ্ঞার কারণে এক বছরেরও বেশি সময় ধরে লেনদেন স্থবির হয়ে আছে। ইতিমধ্যে প্রকল্পের প্রায় ৬৯ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, বেশির ভাগ প্রকল্পেই স্থবিরতা আছে। এর মূল কারণ হলো- চাহিদামতো অর্থছাড় না হওয়া।

গত ২০শে আগস্ট বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন আশ্বস্ত করেছেন, বাংলাদেশে চীনের অর্থায়নে বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পগুলো পরিকল্পনা অনুযায়ী চলমান থাকবে। এর আগে জাপানি রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরির সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে অর্থ উপদেষ্টা জানান, দেশে জাপানি সহায়তায় চলা প্রকল্পগুলো বন্ধ হবে না। জাপান বাংলাদেশের উন্নয়নের বড় অংশীদার।

জানা গেছে, উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর স্থবির অবস্থা নিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ। তখন বলা হয়, অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ এগোচ্ছে না। এ ছাড়া অনুমোদন পাওয়া নতুন প্রকল্পগুলোতেও বরাদ্দ মিলছে না।

সাবেক পরিকল্পনা সচিব মামুন-আল-রশিদ বলেন, উন্নয়ন সহযোগীরা অনেকেই অর্থছাড় করছে না। সরকারের উচিত দ্রুত প্রকল্পগুলোর সমাধান দেয়া। এতে নেতিবাচক পরিস্থিতির কিছুটা অবসান ঘটবে।

এদিকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) বলছে, চলতি অর্থবছরের অর্থছাড়ে করুণ চিত্র বিরাজ করছে। গত তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড় করেছে ৮৪ কোটি ৬১ লাখ ডলার। কিন্তু গত অর্থবছরের তিন মাসে উন্নয়ন সহযোগীরা ছাড় করেছিল ১২৮ কোটি ১৭ লাখ ডলার।  (সুত্র-মানব জমিন)

 

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।