আদালত চত্তরে আসামীর উপর হামলা এ দায় কার?
সিলেটে আদালত চত্বরে পুলিশ হেফাজতে থাকা অবস্থায় সিলেট সিটি কর্পোরেশনের ৩নং ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর আবুল কালাম আজাদ লায়েককে কিলঘুষি ও লাথি মেরেছে কিছু লোক। গত ২৪ নভেম্বর দুপুরে সিলেট চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের সামনে এমন ঘটনা ঘটেছে এমন একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এসময় লায়েককে দালাল ও দখলবাজ আখ্যা দিয়ে কয়েকজনকে গালাগালও করেতে দেখা যা।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর গ্রেফতার হন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সাবেক মন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক, দীপু মনিসহহ অনেকে। তাদেরকে আদালতে তোলার পর আদালত চত্বরেই তাদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে। সীমান্তে আটক হওয়ার পর সিলেটের আদালতে তোলার সময় সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের ওপর হামলা হয়। আদালতে প্রবেশের সময় আদালত প্রাঙ্গণে থাকা কিছু ব্যক্তি শামসুদ্দিন চৌধুরীকে বেধড়ক কিলঘুষি মারেন। অনেকে ডিম ছোড়ার পাশাপাশি জুতাও নিক্ষেপ করেন। কেউ কেউ শামসুদ্দিন চৌধুরীর নাম উল্লেখ করে ‘ভুয়া ভুয়া’সহ বিভিন্ন স্লোগান দেন।
এর আগে ২০ আগস্ট ঢাকার একটি আদালত থেকে কারাগারে নেওয়ার পথে আদালত প্রাঙ্গণে সাবেক সমাজ কল্যাণমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং সাবেক যুব ও ক্রীড়া উপমন্ত্রী আরিফ খান জয়ের ওপর হামলার অভিযোগ উঠে।
বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট, হেলমেট পরা বিচারপতি মানিককে প্রিজন ভ্যান থেকে নামানো মাত্রই উত্তেজিত ব্যক্তিরা পুলিশের বাধা টপকে তার উপর হামলার চেষ্টা করতে থাকেন। এ সময় তার ওপর জুতা ও ডিম নিক্ষেপ করা হয়।
প্রিজন ভ্যান থেকে আদালত ভবনের গেইট পর্যন্ত নিয়ে আসার মধ্যেই বেশ কয়েকজন তাকে আঘাত করেন। তার মাথার হেলমেটও খুলে পড়ে যায়। উপস্থিত পুলিশ সদস্যরা এ অবস্থাতেই তাকে দ্রুত আদালত ভবনে ঢুকিয়ে গেইট লাগিয়ে দেন।
এ সময় আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত একাধিক সংবাদকর্মী এবং পুলিশ জানিয়েছেন যে ক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা বেশিরভাগই আদালতের আইনজীবী এবং আদালতের বিভিন্ন দপ্তরের কর্মচারী যারা বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে যুক্ত।
সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিম বলেন, ‘পুলিশি নিরাপত্তাতে একজন বন্দী যিনি বয়োজ্যেষ্ঠ অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, তার সাথে সিলেট আদালত প্রাঙ্গণে যে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে তা আমাদের ক্ষুব্ধ করেছে। এ ধরনের ঘটনা সাবেকি প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজনীতির ধারাবাহিকতা বলে মনে হচ্ছে এবং এ ধরনের আচরণ কোনো সুখকর ভবিষ্যতের প্রত্যাশা জাগায় না।’
আদালত প্রাঙ্গণে আসামিদের ওপর হামলা ও নিরাপত্তা বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সম্প্রতি মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর এবং আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো ড. আলী রীয়াজ।
তিনি লিখেছেন, ‘আদালত প্রাঙ্গণে এবং আদালতে সংঘটিত সাম্প্রতিক ঘটনাবলিকে আমি উদ্বেগজনক বলে মনে করি। যে কোনো অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তির ন্যায়বিচার প্রাপ্তি যেমন অধিকার তেমনি তার নিরাপত্তা বিধান সরকারের দায়িত্ব।
আদালত চত্বরে আসামির ওপর হামলা কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয় বলে মনে করেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। গত ২৯ আগস্ট সচিবালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আদালতে যাওয়ার সময় কখনো কাউকে আক্রমণ করা উচিত নয়, এটি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এমন ঘটনা যাতে না হয়, সে বিষয়ে বিভিন্ন কৌশল ও চিন্তাভাবনা করছেন বলেও জানান এই উপদেষ্টা।
মানবাধিকারকর্মী ও আইনজ্ঞরা বলছেন, ফৌজদারি অপরাধে কাউকে গ্রেপ্তার করার পর তাঁর সঙ্গে নিষ্ঠুর, অমানবিক বা লাঞ্ছনাকর কোনো আচরণ করা যাবে না।
এ বিষয়ে মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) চেয়ারপারসন জেড আই খান পান্না গণমাধ্যমকে বলেন, যখন কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনা হয়, তখন তাঁকে শারীরিক কিংবা মানসিক কোনো প্রকারের নির্যাতন করার সুযোগ নেই। আসামিকে নির্যাতন কিংবা হেনস্তা করা ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, আসামির ওপর হামলা ফৌজদারী অপরাধ। যে বা যারা এই হামলা করবে তাদের আইনের আওতায় আনা উচিত। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলে ভিডিওর মাধ্যমে হাজিরা নেওয়া উচিত।